Topic: আজব জগৎ শাওলিন টেম্পল !

http://i49.tinypic.com/10eimhv.jpg

চীনের হেনান প্রদেশে অবস্থিত এক সময়ের চীনের রাজধানী লুইয়াং থেকে ৬০ কিমি. দক্ষিণে অবস্থিত 'শাওলিন টেম্পল' পৃথিবীর অন্যতম একটি বিখ্যাত স্থান। এই শাওলিন টেম্পলকে ঘিরে পৃথিবীজুড়ে অনেক কিংবদন্তি ও রহস্য প্রচলিত রয়েছে। বিস্ময়কর মার্শাল আর্ট, কুংফু শিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশ এই শাওলিন টেম্পলকে ঘিরেই। জেট লি, জ্যাকি চ্যান কিংবা ব্রুস লিকে যারা চিনেন তাদের কাছে শাওলিন টেম্পল নামটি মোটেও অচেনা নয়। এটিই সম্ভবত চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির। শুধুমাত্র দীর্ঘ ইতিহাস আর বুদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যই এটি বিখ্যাত নয়। এর সবচেয়ে বড় খ্যাতি মার্শাল আর্ট এবং কুংফুর জন্য।

শাওলিন টেম্পলে কুংফু শিখতে আসা শিক্ষার্থীদের সন্ন্যাসী বলা হয়। কিন্তু কুংফুর মতো ভয়াবহ লড়াইয়ে সিদ্ধহস্ত হতে যারা প্রশিক্ষিত হয়, তারা কেমন করে সন্ন্যাসী হন? অবাক করার মতো বিষয় হলেও ইতিহাস তাই বলে। আজ থেকে দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এই অঞ্চলে সূচনা হয় 'জেন' নামক বৌদ্ধধর্মের একটি ধারার। একই সঙ্গে কুংফুরও যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় 'জেন' আর 'কুংফু' চলে গেছে দু'পথে। কিন্তু শাওলিন টেম্পলের সন্ন্যাসীরা 'জেন' আর কুংফু' এই দুই জীবনাদর্শকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন তাদের জীবনে। তাই ধর্মের স্থিরতা আর মানসিক দৃঢ়তা তাদের করেছে শান্ত, সৌম্য। পাশাপাশি কুংফুর কলাকৌশল তাদের করছে ক্ষিপ্র ও শক্তিশালী। আর এ কারণেই শাওলিন টেম্পলের অধিবাসীদের 'যোদ্ধা সন্ন্যাসী' বলে অভিহিত করা হয়।

বছর তিরিশেক আগেও শাওলিন টেম্পলের কার্যক্রম বাইরের পৃথিবীর কাছে ছিল অনেকটাই অজানা আর রহস্যময়। শাওলিন টেম্পল তখনো ছিল সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পরবর্তীতে কুংফু বিষয়ক চলচ্চিত্র আর শাওলিন সন্ন্যাসীদের নানা প্রদর্শনীর মাধ্যমে শাওলিন টেম্পলের নাম দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য শাওলিন টেম্পল হয়ে ওঠে জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। টেম্পলের কার্যক্রম শুরু হয় খুব ভোরে। প্রথমেই দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যান চর্চা করেন সন্ন্যাসীরা। ধ্যান শেষে শুরু হয় কুংফু প্রশিক্ষণ। দীর্ঘক্ষণ কুংফু প্রশিক্ষণ শেষে পাঠ করা হয় পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। এরপর আরম্ভ হয় জাগতিক কাজ। বেঁচে থাকার জন্য রুটি-রুজিও তো করতে হবে। এজন্য শাওলিন সন্ন্যাসীরা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নানা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে। এছাড়া শাওলিন টেম্পল বিষয়ক নানারকম স্যুভেনির বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এ ধরনের জাগতিক কাজে সন্ন্যাসীরা মন থেকে সায় পান না ঠিকই; কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য এসব অপ্রিয় কাজগুলোও ভীষণ নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের সঙ্গে সম্পন্ন করেন তারা।

প্রতি বছর হাজার হাজার কমবয়সী ছেলে শাওলিন টেম্পলে এসে হাজির হয় কুংফু শিখার জন্য। আগ্রহী এই শিশু-কিশোর-তরুণদের জন্য উপাসনালয়ের চারপাশে স্থাপন করা হয়েছে ২০টি স্কুল। নাম স্কুল হলেও এখানে পড়াশোনা করা মোটেও সহজ নয়। একবার ভর্তি হয়ে গেলে দেখা যাবে অসম্ভব কষ্টসহিঞ্চু, ধৈর্য, নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় ছাড়া ওখান থেকে শেখা যায় না কিছুই। কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। সপ্তাহে একদিন ছুটি, বাকি ছ'দিনই চলে কঠিন প্রশিক্ষণ। প্রতিদিন চারটি সেশনে ভাগ করা সময়ে সারাক্ষণই কঠোর শিক্ষণ। কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে অন্য সব কাজই অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজেকেই করতে হয়। খাবার পরিবেশন করা হয় উপাসনালয়ের সামনে খোলা জায়গায়। এমনকি যখন বরফ পড়ে, হাড় কনকনে ঠাণ্ডাতেও বাইরে বসেই খেতে হয়। রাতে শোয়ার জন্য রয়েছে লম্বা হলঘর। সেখানে শিক্ষার্থীরা পাশাপাশি শুয়ে অঘোরে ঘুমায়। সারাদিন পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চায় শরীর, বিছানাই পিঠ ঠেকা মাত্রই দুই চোখ বুজে আসে নিজেরই অজান্তে। এই কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাঝে বিনোদনের জন্য সময় বরাদ্দ রয়েছে সপ্তাহের একটি দিনের ঘণ্টা কয়েক। ওই দিন খোলা জায়গায় প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটি সিনেমা দেখানোর আয়োজন করা হয়। বেশিরভাগ সময়ই সিনেমাগুলো হয় কুংফু বিষয়ক। সারাটা সপ্তাহ কঠিন নিয়মের মধ্যে কাটানো প্রশিক্ষণার্থীরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে এই ক'টা ঘণ্টার জন্য। মুগ্ধ চোখে সবাই তাকিয়ে থাকে সিনেমার ঝলমলে জীবনের দিকে। হয়তো কল্পনায় নিজেকে ভেবে নেয় সিনেমার ওই দুর্ধর্ষ কুংফুর দক্ষ নায়কের জায়গায়। তবে কুংফুর পাশাপাশি চীনের ভাষা অর্থাৎ ম্যান্ডারিন এবং অঙ্কও শিখতে হয় এখানকার প্রশিক্ষণার্থীদের। তবে মূল মনোযোগ এবং একাগ্রতা থাকে একদিকেই কেন্দ্রীভূত। আর সেই দিকটি হচ্ছে এক এবং অদ্বিতীয় কুংফু।

যতদূর জানা যায়, শাওলিন টেম্পলের এই বিশেষ চর্চার আগমন ঘটে ভারতীয় সন্তবোধি ধর্মের মাধ্যমে। আর এই কুংফু নামক অসামান্য শিল্পটির অনন্য সাধারণ কৌশল আর ভঙ্গিগুলো ধার করা হয়েছে বিভিন্ন জীবজন্তুর নানা ভঙ্গিমা থেকে। বাঘ, ঈগল, সাপ, ভালুক, ড্রাগন ইত্যাদি নানা জীবজন্তু কীভাবে কোন পদ্ধতিতে আক্রমণ করে, মুহূর্তের মধ্যে সরে যায় শত্রুর নাগালের বাইরে, কীভাবেই বা ছোটে বিদ্যুৎগতিতে এসব কিছু পর্যবেক্ষণ করে তার নির্যাসগুলো নিয়ে আসা হয়েছে কুংফুতে। কুংফু নিয়ে শাওলিন টেম্পলে প্রচলিত রয়েছে একটি প্রবচন 'আত্মরক্ষা কর কুমারী মেয়ের মতো, আর আক্রমণ কর বাঘের মতো,' অর্থাৎ লড়াইয়ে সাহসের পাশাপাশি সতর্কও হতে হয়, না হলে সমূহবিপদ।

কথিত আছে বোধিধর্ম চতুর্থ শতকের সূচনালগ্নে ভারত থেকে চীনে এসেছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য। শাওলিনে তিনি খোঁজ পান 'জেন' মতাবলম্বীদের। যাদের বিশ্বাস ছিল যে নিবিড় তপস্যা এবং আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে বোধি বা নির্বাণ লাভ করা যায়। তারা জোর দিয়েছিলেন নিজের অন্তরের খোঁজ করা এবং একাকী তপস্যার ওপর। বোধিধর্মও এই মতে উপাসনালয়ের উপরের পাহাড়ের নির্জন এক গুহায় দীর্ঘ ৯ বছর নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তপস্যায়। বলা হয়, সেই সময়ে তার ছায়া নাকি গুহার দেয়ালের গায়ে বসে গিয়েছিল চিরস্থায়ীভাবে। সেই ছায়া খোদাই করা প্রস্তর খণ্ডটি শাওলিন টেম্পলে সংরক্ষিত আছে আজও।

সুই সাম্রাজ্যের (৫৮১-৬১৪ খ্রিস্টাব্দ) পর সম্রাট 'ওয়েন ডি' শাওলিন টেম্পলের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলের বিশাল একখণ্ড জমি। ওখানকার কুংফু কৌশলে পারদর্শী একদল সন্ত হয়ে ওঠেন ভীষণ জনপ্রিয়। তাদের অসামান্য কৌশল আর ক্ষিপ্রতার কথা কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সত্যের পাশাপাশি নানারকম অতিকথনের মধ্যদিয়ে শাওলিন টেম্পল হয়ে ওঠে রহস্যময় এক স্থানে। 'জেন' ধর্মাচার আর শাওলিন কুংফু চীন পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে জাপানসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও। জুয়ান সাম্রাজ্যে (১২৮০-১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দ) শাওলিন কুংফুর জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী। সেসময় প্রায় ২০ হাজার সন্ন্যাসী শাওলিন টেম্পলে প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা স্তিমিত হয়ে আসে। অবশ্য বর্তমানে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে। উপাসনালয়ের মূল স্থাপনাগুলো নতুন ভাবে তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী আর সন্ন্যাসীতে ভরে উঠেছে শাওলিন টেম্পলের চত্বর।

স্থানীয় অর্থাৎ চীনের অধিবাসী ছাড়া শাওলিন টেম্পল থেকে সত্যিকারের শিক্ষা অর্জন করা ভীষণ কঠিন ব্যাপার। মনের শুদ্ধতার সঙ্গে কুংফু'র অসামান্য শারীরিক দক্ষতার কীভাবে মিশেল ঘটানো যায় তার নানা গোপন কলাকৌশল বিদেশিদের কাছে সহজে ভাঙতে চান না সন্ন্যাসীরা। এজন্যই বলা হয় যে শাওলিন টেম্পলের সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে কিছু শিখতে হলে আগে তার বিশ্বাসভাজন হতে হবে, হতে হবে বন্ধু। নতুবা শেখা হবে না কিছুই। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ, যেমন থাইল্যান্ড আর লাওসে তীর্থে আসা সন্ন্যাসীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন সরকার কিংবা দেশবাসীই, চীনে তেমন রেওয়াজ নেই। ফলে নিবিষ্ট মনে শুধু ধ্যান এবং কুংফু চর্চা করে যাবেন তার উপায় নেই শাওলিন টেম্পলে। উপার্জনের ব্যবস্থাও করতে হয় নিজেকেই। তাই এখানকার সন্ন্যাসী হয়েও রক্ষা নেই। অর্থের খোঁজে বেরুতেই হয়, তা যত অপছন্দই হোক না কেন।

শাওলিন টেম্পলে যোদ্ধা সন্ন্যাসীদের আজব জগত সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কোন কমতি নেই। বিশ্ব জুড়ে অনেক কিশোর তরুণই পর্দার ব্রুস লী, জেট লী কিংবা জ্যাকি চ্যান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। আর এ সবই শাওলিন টেম্পলের মোহময় আবেদনের ফসল।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখকঃ রনক ইকরাম।

একজন মানুষের জীবন হচ্ছে~ক্ষুদ্র আনন্দের সঞ্চয়,একেকজন মানুষের আনন্দ একেক রকম...http://www.rongmohol.com/uploads/1805_adda_logo_4.gif

গনযোগাযোগ সচিবঃ ফাউন্ডেশন ফর ওপেন সোর্স সলিউশনস বাংলাদেশ, নীতি নির্ধারকঃ মুক্ত প্রযুক্তি।