Topic: নিরাপদ মাতৃত্ব যেভাবে সম্ভব - অধ্যাপক ডা. নাসিমা বেগম
অধ্যাপক ডা. নাসিমা বেগম
মহাসচিব
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল
সোসাইটি অব বাংলাদেশ
নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে এমন একটি অবস্থা বা পরিবেশ বোঝায় যেখানে একজন নারী
গর্ভবতী হবেন কি না তা নিজের বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
গর্ভবতী হলে নিম্নলিখিত সেবাগুলো নিশ্চিতভাবে পাবেন। রাষ্ট্রের কাছে বা সমাজের কাছে এটা তার অধিকার।
গর্ভকালীন চিকিৎসাসেবা : এ সংক্রান্ত জটিলতা নির্ণয়, তার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা এখানে অন্তর্ভুক্ত।
প্রসবের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ধাত্রীর (স্কিলড বার্থ এটেনডেন্ট) দ্বারা নিরাপদ প্রসব সেবা পাবেন।
প্রয়োজনে জরুরি প্রসূতি সেবার লক্ষ্যে রেফারের ব্যবস্থা থাকবে; কাছের হাসপাতালে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থা পাবেন।
প্রসব পরবর্তী প্রয়োজনীয় সেবা :
নবজাতকের সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থাও এখানে অন্তর্ভুক্ত।
উন্নত দেশগুলোতে প্রতিটি নারী উপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে এক-চতুর্থাংশ মাত্র আংশিকভাবে সেবা গ্রহণ করেন। প্রতিটি গর্ভই ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভকালীন নিরাপদ কাটালেও প্রসব জটিলতায় অনেক মা মৃত্যুবরণ করেন। বছরে প্রায় ৭ হাজার ৩৩০ জন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং এর দ্বিগুণ বিভিন্ন রকম জটিলতায় সারা জীবন অতিবাহিত করেন। এর মধ্যে ফিসচুলা, যোনীপথ ছিঁড়ে এক হয়ে যাওয়া, তলপেটে প্রদাহ, জরায়ু নেমে যাওয়া, স্বাস্থ্যহীনতাসহ অনেক রকম কষ্টই ভোগ করেন আমাদের মায়েরা।
শ্রীলংকায় মাতৃমৃত্যু নেই বললেই চলে। এটি সম্ভব হয়েছে দেশের ৯৯ ভাগ লোক শিক্ষিত এবং প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ ডেলিভারি হাসপাতালে হয়ে থাকে যা অভিজ্ঞ ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ঘটে।
বাংলাদেশে ২০১০ সালের এক জরিপে দেখা গেছে ৭৫ ভাগ ডেলিভারি গ্রামের বাড়িতে হয় এবং ৭৫ ভাগ ডেলিভারি অনভিজ্ঞ ধাত্রী দ্বারা করানো হয়। শহরাঞ্চল ও তুলনামূলক ধনী এবং শিক্ষিত মায়েরা হাসপাতাল সেবা বেশি গ্রহণ করেন। কেন আমাদের মায়েরা হাসপাতালে আসেন না সেটা খুঁজতে গেলে অনেক কারণ চোখে পড়ে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে ৫০-৬০ ভাগ পরিবার মনে করে গর্ভকালীন সেবা নেয়ার দরকার নেই, সবকিছু প্রাকৃতিক নিয়মে আল্লাহর ইচ্ছায় হবে আর্থিক সংকট, হাসপাতাল দূরে, রাস্তাঘাট ভালো নয়, বাড়ি থেকে যাওয়ার অধিকার নেই, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা প্রভৃতি অন্যতম।
যেসব কারণে মায়েরা মৃত্যুবরণ করেন তা হল
রক্তক্ষরণ প্রসব পরবর্তী সময়ে জরায়ু সংকুচিত না থাকলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
খিঁচুনি একলাম্পশিয়া, রক্তচাপ (১৪০/৯০) বেশি হয়ে খিঁচুনি হতে পারে। এতেও মা ও শিশু উভয়েরই জীবনহানি ঘটে।
বিলম্বিত ও বাধাপ্রাপ্ত প্রসব বিভিন্ন কারণে ১২ ঘণ্টার অধিক প্রসব সময় অতিবাহিত হলে বা প্রসব ব্যথা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও যোনীপথ সংকুচিত বা সন্তানের অবস্থান অস্বাভাবিক থাকলে প্রসব বাধাগ্রস্ত হয়। এগুলো যথাসময়ে নির্ণয় করা জরুরি। ১২ ঘণ্টার অধিক যে কোন প্রসব (১ম বার) এবং ৬ ঘণ্টা (২য় থেকে প্রতিবার গর্ভ) সময় পার হয়ে গেলে গর্ভবতীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
পানি ভেঙে যাওয়া এবং ব্যথা না ওঠা, প্রদাহ দেখা দেয়া (ইনফেকশন)।
গর্ভবতীর জ্বর ম্যালেরিয়া, মূত্রথলির ইনফেকশন বা অন্য কোন মেডিকেল রোগ যেমন: অ্যানিমিয়া, হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ও জন্ডিস থাকলে হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে হবে।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো
সিএসবিএ বা দক্ষ ও প্রশিক্ষত ধাত্রী দ্বারা গর্ভকালীন, প্রসবকালীন, প্রসব পরবর্তী সেবার ব্যবস্থা, প্রতি ইউনিয়নে ১-২ জন ট্রেনিং নিয়ে তৈরি আছেন তারা বাড়িতে গিয়ে ডেলিভারি করান ।
কমিউনিটি ক্লিনিক মেটারনিটি জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডাক্তার নিয়োগ পেয়েছেন।
জরুরি প্রসূতি সেবা দান
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাহায্যের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সাহায্য (ডিমান্ড সাইড ফাইন্যান্সিং বা ডিএসএফ) বা মাতৃমৃত্যুর ভাউচার প্রদান।
সেবা কেন্দ্রে বা হাসপাতালে ডেলিভারির পরপরই ২য় সন্তান নেই জেনে ২টি ইনজেকশন অক্সিটোসিন মাংসে দেয়া বা বাড়িতে ডেলিভারি হলে ২টি মিজোপ্রস্টল বড়ি খেয়ে নেয়া কার্যক্রম।
খিঁচুনি প্রতিরোধকল্পে ইনজেকশন ম্যাগনেসিয়াম সালফেট প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রদান।
পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সবরকম ব্যবস্থা যেমন কনডম, খাওয়ার বড়ি (সুখী), ইমারজেন্সি পিল, ইনজেকশন (প্রতি ৩ মাসে), কপার আইইউডি, ইমপ্লান্ট (সুইয়ের মতো হাতে চামড়ার নিচে নিয়ে নেয়া), স্থায়ী ব্যবস্থা টিউবেকটমি ও ভেসেকটমি এখন অনেক নিরাপদ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় করা হয়ে থাকে।
জেলা হাসপাতালগুলো নারীবান্ধব করার কার্যক্রম চলছে যাতে মায়েরা হাসপাতালে এসে স্বস্তি পায় ।
অবশেষে বলতে হয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সমাজের প্রতিটি মানুষকে নারীর গর্ভ ও প্রসবজনিত সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াই প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
সুত্র: দৈনিক যুগান্তর