Topic: অটিস্টিক শিশু
ডা. কানিজ ফাতেমা
তিন বছরের ছেলে অর্থ। ডাগর চোখ, এলোমেলো চুল। আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক একটি ছেলে হলেও আমাদের কাছে এসেছে একটি গুরুতর সমস্যা নিয়ে। অর্থ একজন অটিস্টিক শিশু।
অটিজম শিশুর আচরণগত একটি সমস্যা যেখানে শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
অটিজমের লক্ষণ
শিশুদের বিকাশের প্রথম তিন-চার বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। কোন কোন ক্ষেত্রে বাবা-মা লক্ষণগুলো শনাক্ত করতে দেরি করেন। যার কারণে চিকিৎসাও দেরি হয়ে যায়। যেসব লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে শিশু অটিস্টিক, তা হল:
- শিশুর কথা বলতে দেরি হওয়া।
সামাজিক যোগাযোগ অর্থাৎ অন্য শিশুদের সঙ্গে, বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন না করা।
চোখের দিকে না তাকানো, হাসির প্রত্যুত্তরে না হাসা।
কথা জানলেও তার মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা না করা।
শিশুর নিজস্ব বানানো ভাষায় কথা বলা।
প্রথাগত/বয়সোচিত খেলায় অংশগ্রহণ না করা।
খেলনা/ব্যবহার্য অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে ভাগাভাগি না করা।
একই খেলা/নিয়ম/আচরণের পুনরাবৃত্তি করা।
খিটখিটে মেজাজ।
ডাকলে সাড়া না দেয়া ইত্যাদি।
উল্ল্লেখ্য, অটিস্টিক শিশুদের বিকাশ তথা বসতে শেখা, হাঁটা, চোখে দেখা, কানে শোনা, হাতের কাজ ইত্যাদি সাধারণত স্বাভাবিক থাকে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা, খিঁচুনি এবং অন্যান্য আচরণগত সমস্যা থাকে।
শিশুর বিকাশগত এই সমস্যাটির মাত্রা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কেউ খুব অল্প মাত্রার আবার কেউ গুরুতর সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে।
কেন অটিজম হয়?
এ প্রশ্নটা সব বাবা-মাই আমাদের করেন, যার উত্তর দেয়াটা বেশ কঠিন হয়ে যায়। আসলে অটিজমের প্রকৃত কারণ কি সেটা জানার জন্য অদ্যাবধি অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। যেসব কারণের সঙ্গে অটিজমের যোগসূত্র পাওয়া গেছে সেগুলো হল
জেনেটিক/বংশগত একই পরিবারের মধ্যে অটিজমের পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় যদি মার রুবেলা হয়।
- মস্তিষ্কের প্রদাহ।
- সিসা বিষক্রিয়া ইত্যাদি।
- চিকিৎসা
অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন একটি সমষ্টিগত চিকিৎসা ব্যবস্থা যা শিশুদের যথাসম্ভব বিকাশে সাহায্য করবে।
প্রথমেই শিশুর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে শিশুটি কোন পর্যায়ে আছে। এরপর অবস্থাভেদে পর্যায়ক্রমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
অটিস্টিক শিশুদের সমষ্টিগত চিকিৎসা হওয়া উচিত এমন
১. শিশু চিকিৎসক/শিশু নিউরোলজিস্ট শিশুর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা দেবেন।
২. সাইকোলজিস্ট
- বাবা-মাকে কাউন্সিল করবেন
- ব্যবহারগত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করবেন
৩. স্পিচ থেরাপিস্ট
- কথা বলতে সাহায্য করবেন
৪. অকুপেশনাল থেরাপিস্ট
- ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ শিক্ষা দেবেন।
- কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেবেন।
৫. স্পেশাল স্কুল
- এখানে অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেবেন।
আমরা যারা অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত, সচরাচর একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই, আমার ছেলে অথবা মেয়েটা কি ভালো হবে? উত্তরটা খুব সহজ নয়। কেননা এটা শিশুর রোগ, চিকিৎসার পরিসর, বাবা-মার সহযোগিতা, আর্থিক অবস্থা, সর্বোপরি সামাজিক অবকাঠামোর ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। যেসব শিশুর সমস্যা কম, তারা যথাসময়ে চিকিৎসা পেলে স্বাভাবিক স্কুলে যেতে পারে আবার যেসব শিশু গুরুতর সমস্যায় ভুগছে, তাদের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
অভিভাবকদের উদ্দেশে কিছু কথা
অটিজম কোন নিরাময়যোগ্য রোগ নয়, তবে প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই মননগত দিক দিয়ে সম্ভাবনাময়। প্রথমেই বাবা-মা হিসেবে আপনাকে যথেষ্ট মানসিক শক্তির অধিকারী হতে হবে- কোনভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। এমন অনেক অটিস্টিক শিশু আছে, যারা বহু প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে এখন প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। তাই ধৈর্য ধরুন, শক্ত হাতে আপনার শিশুটির হাত ধরুন
সফলতা আসবেই।
অটিজম চিকিৎসা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই অটিজম চিকিৎসা চলছে তবে যে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রয়োজন তা খুব কম প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অটিজম চিকিৎসায় হাত বাড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অটিজমের জন্য অত্যাধুনিক সামষ্টিক এবং সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই সেন্টারের নাম সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম যেখানে রয়েছে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অটিজম শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, কাউন্সিলিং। এছাড়া এখানে রয়েছে অটিস্টিক শিশুদের ডে কেয়ার, যেখানে প্রশিক্ষিত শিক্ষদের মাধ্যমে বিশেষ শিক্ষা দান করা হয়।
প্রতিটি শিশুর মাঝে আছে অপার সম্ভাবনা অটিস্টিক শিশুরাও এর ব্যতিক্রম নয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শিশু নিউরোলজি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়