Topic: জরায়ুর স্থানচ্যুতি/প্রলাপ্স

http://my.jetscreenshot.com/2862/m_20110315-0dc3-24kb.jpg

মার্জিত এক ভদ্রলোক চিকিত্সকের চেম্বারে এসে ঢুকলেন এবং তার সঙ্গে বৃদ্ধা মা খুব লাজুকভাবে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। মা তার অসুবিধা সম্পর্কে কথা বলতে খুব দ্বিধান্বিত এবং অবশেষে জানা গেল—মহিলাটির জরায়ু নিচে নেমে এসেছে এবং তিনি এটা থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। তার এই রোগটিকে জরায়ুর স্থানচ্যুতি বা ডাক্তারি ভাষায় ইউটেরো-ভ্যাজাইনাল প্রলাপ্স (Utero-vaginal Prolapse) বলা হয়। আমাদের দেশে এরকম রোগীর সংখ্যা প্রচুর এবং বহু মা জীবনের শেষ ধাপে এ রোগের বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ ও জটিলতা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন।

কেন হয় এবং কাদের হয়?
সেসব মায়ের হয় যারা জরায়ুপথে সন্তান জন্মদান করেছেন এবং গর্ভধারণ অবস্থায়, প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সমস্যা ও অনিয়মের শিকার হয়েছেন। যেমন—
১. যারা অল্প বয়সে (২০ বছরের নিচে) সন্তান ধারণ ও জন্মদান করেছেন।
২. যারা অনেক সন্তান জন্মদান করেছেন এবং ঘন ঘন সন্তান জন্মদান করেছেন।
৩. যারা গর্ভধারণকালীন অপুষ্টিতে ভুগেছেন।
৪. যারা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসব বেদনায় ভুগেছেন।
৫. অপ্রশিক্ষিত দাইয়ের মাধ্যমে ভুল পদ্ধতিতে যারা সন্তান প্রসব করেছেন, যেমন— (ক) জরায়ুর মুখ পুরোপুরি খোলার আগেই চাপ দিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করা। (খ) জরায়ুর গর্ভফুল বের করার জন্য জরায়ুকে নিচের দিকে চাপ দেয়া এবং সংযোগ নাড়ি ধরে নিচের দিকে টান দেয়া।
৬. সন্তান প্রসব করার পরপরই প্রসুতিকে ভারি কাজে নিযুক্ত করা, যেমন— টিউবওয়েল চাপা, কলসি ভরে পানি আনা, ঢেঁকিতে পাড় দেয়া ইত্যাদি।
৭. দীর্ঘস্থায়ী কাশি ও কোষ্ঠকাঠিন্য এ রোগের প্রকাশকে আরও প্রকট করে।
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে যৌবনে রোগের লক্ষণ আংশিকভাবে প্রকাশ পেলেও সমস্যা বেড়ে যায় মেনোপজ বা স্থায়ীভাবে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর।

প্রকারভেদ
জরায়ুর স্থানচ্যুতিকে বিভিন্ন ডিগ্রি অনুযায়ী ভাগ করা যায়—
১ম ডিগ্রি : জরায়ু তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে নিচে নেমে আসে, তবে জরায়ু মুখসহ পুরো জরায়ু মাসিকের রাস্তা বা যোনিপথের মধ্যেই অবস্থান করে।
২য় ডিগ্রি : হাঁটাচলা ও ভারি কাজ করলে জরায়ু মুখ (ঈবত্ারী) মাসিকের রাস্তা বা যোনিপথের বাইরে চলে আসে এবং জরায়ুর বাকি অংশ যোনিপথের মধ্যেই অবস্থান করে। বিশ্রাম করলে বের হওয়া অংশ যোনিপথের মধ্যে ঢুকে যায়।
৩য় ডিগ্রি : সম্পূর্ণ জরায়ু যোনিপথের বাইরে বের হয়ে থাকে।

লক্ষণসমূহ
১. রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী যোনিপথে ভারি কিছুর উপস্থিতি অনুভব করে এবং যখন হাঁটাচলা বা কাজকর্ম করে তখন তার মনে হয় যে মাসিকের রাস্তা দিয়ে কিছু একটা বের হয়ে আসবে। রোগের ২য় এবং ৩য় ডিগ্রিতে হাঁটাচলার সময় জরায়ু আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে যোনিপথের বাইরে চলে আসে এবং ক্রমান্বয়ে কাজকর্ম ও হাঁটাচলা করতে বাধার সৃষ্টি হয়।
২. পিঠ ও কোমরে ব্যথা অনুভূত হয়।
৩. জরায়ু স্থানচ্যুতির সঙ্গে সঙ্গে রোগীর প্রস্রাবে অসুবিধার সৃষ্টি হয় যেমন— প্রস্রাব পুরোপুরি হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে মাসিকের রাস্তায় হাত দিয়ে জরায়ুকে উপরের দিকে উঠিয়ে প্রস্রাব সম্পূর্ণ করতে হয় এবং অনেকের ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হয়।
৪. অনেক ক্ষেত্রে রোগী পায়খানা করতে সমস্যায় পড়েন এবং শক্ত বা কষা পায়খানা হলে মাসিকের রাস্তায় হাত দ্বারা চাপ দিয়ে পায়খানা করার প্রয়োজন পড়ে।
৫. অনেক রোগীর জরায়ু স্থানচ্যুতির পর লালচে স্রাব দেখা দেয় যা এ রোগ থেকে সৃষ্ট ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে।

রোগ শনাক্তকরণ
রোগের লক্ষণগুলো বিচার করে এবং রোগীর শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমেই এ রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। তবে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে রোগীর অন্য কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করার জন্য পেটের আলট্রাসনোগ্রাম এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইনট্রাভেনাস ইউরোগ্রাম করার প্রয়োজন হয়।

রোগ থেকে সৃষ্ট জটিলতা
দীর্ঘদিন চিকিত্সা না করালে বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি হয়, যেমন— জরায়ুর মুখে ঘা বা ডিকুবিটাস আলসার, প্রস্রাবে ইনফেকশন, প্রস্রাবের থলিতে এমনকি কিডনিতে ইনফেকনশন হতে পারে।

প্রতিরোধের উপায়
যারা এরই মধ্যে জরায়ুর স্থানচ্যুতিতে ভুগছেন তাদের চিকিত্সার পাশাপাশি সবাইকে সামগ্রিকভাবে সচেতন হতে হবে, যাতে যেসব মহিলা বর্তমানে মা হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে মা হবেন তারা যেন কেউ এই রোগে আক্রান্ত না হন। রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে গর্ভধারণকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে—
১. ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. ঘন ঘন গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. গর্ভবতী মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য ও বিশ্রামের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।
৪. নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্সের সাহায্যে অথবা বাড়িতে অন্ততপক্ষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. প্রসবকালীন সময় দীর্ঘায়িত হলে এবং প্রসবকালীন অন্য যে কোনো জটিলতা দেখা দিলে প্রসবকালীন সেবা প্রদানকারীকে তা তত্ক্ষণাত্ শনাক্ত করতে হবে এবং রোগীকে দ্রুত উন্নত চিকিত্সা দিতে হবে।
৬. সন্তান জন্মদানের পর ৪০ দিন পর্যন্ত মাকে ভারি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. সন্তান জন্মদানের পর মাকে নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম করতে হবে যা মায়ের প্রজনন অঙ্গগুলোকে এবং পেট ও পিঠের মাংশপেশিকে গর্ভধারণের পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

চিকিত্সা
জরায়ুর স্থানচ্যুতি এবং এ রোগের জটিলতায় ভুগছেন এমন রোগীর সংখ্যা প্রচুর। সাধারণত বয়স্ক মহিলাদের এ রোগটি হয় তবে যে কোনো বয়সে এর উপসর্গ শুরু হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোনো ওষুধ সেবনে স্থানচ্যুতি প্রতিকার হয় না এবং এ রোগের চিকিত্সা হচ্ছে—অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করা এবং পার্শ্ববর্তী অঙ্গগুলোকে মেরামতের মাধ্যমে শক্তিশালী করা। রোগ শনাক্ত করার পর রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি ও মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর অপারেশনটি করা হয়। এটি অবশ্যই একটি মেজর অপারেশন। তবে দক্ষ গাইনোকোলোজিস্ট দ্বারা অপারেশন করালে অপারেশনকালীন জটিলতা ও পরবর্তী সমস্যা খুব কমই হয় এবং রোগী দ্রুত সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

করণীয়
জরায়ুর স্থানচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকতে হলে সচেতন হতে হবে। এটিকে প্রতিরোধ করার জন্য গর্ভবতী মায়ের সেবা ও নিরাপদ প্রসবকালীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
স্থানচ্যুতি হয়ে থাকলে অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে এবং রোগের জটিলতা সৃষ্টির আগেই চিকিত্সার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে।

ডা. ফেরদৌস আরা সুচি
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গাইনি অ্যান্ড অবস
ডেলটা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল
দারুস সালাম, মিরপুর, ঢাকা
এখানে সুত্র

Shout Me Crunch আমার ব্যক্তিগত টেক ওয়েবসাইট।


Re: জরায়ুর স্থানচ্যুতি/প্রলাপ্স

আসলে বর্তমানে এই রোগগুলো জটিলাকার ধারণ করেছে। তাই আগে থেকে সচেতন হওয়া উচিত।