Topic: অনেক অসুখের কারণ উচ্চ রক্তচাপ

উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে অনেকেরই, অনেকে আছেন ঝুঁকির মধ্যে। লিখেছেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন
আগে ধারণা করা হতো, রক্ত যকৃত বা লিভার থেকে সারা দেহে প্রবাহিত হয়। কিন্তু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রমাণ করেন, রক্ত যকৃত থেকে নয়, হৃৎপিণ্ড থেকে সারা দেহে প্রবাহিত হয়। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকরা বের করেন রক্তনালির গায়ে রক্ত যে চাপ দেয়, তা একেকজনের দেহে একেক রকম। বিশেষ করে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে তা বেশ বেশি।

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ কী
ধমনির মধ্য দিয়ে রক্ত তীব্রগতিতে চলাচল করে। ধমনির ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচলের সময় ধমনির দেয়ালে যে চাপ প্রয়োগ করে, তাকেই রক্তচাপ বলে। মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ মি.মি. অব মারকারির মতো। বয়স ও লিঙ্গভেদে রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়াকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। সাধারণত রক্তচাপ ১৪০/৯০-এর সমান বা বেশি হলে তাকে হাইপারটেনশন বলে।

রক্তচাপ পরিমাপ
১৭০০ সালের দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রাণী দেহে উচ্চ রক্তচাপের বিষয়টি আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে তাঁরা মানুষের দেহে রক্তচাপ পরিমাপ করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৮৬৩ সালে স্ফিগনোগ্রাফ নামক যন্ত্র দিয়ে রক্তচাপ মাপার চেষ্টা করেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৯৮ সালে স্ফিগমোম্যানোমিটার নামক রক্তচাপ মাপার যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়, এখনো পর্যন্ত চিকিৎসকরা এর ওপরই বেশি নির্ভর করেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়ান শল্যবিদ নিকোলাই করোটকফ রক্তচাপ পরিমাপের আধুনিক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। এর ফলে উন্নতি হয় চিকিৎসা ব্যবস্থায়।

উচ্চ রক্তচাপ ও বাংলাদেশ
বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর হার ১১.৩০ শতাংশ। বৃদ্ধ বয়সে শতকরা প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। আমাদের দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপের রোগী নিয়মিত চিকিৎসা নেন না। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, জনসচেতনতা ইত্যাদির কারণে এ দেশে সংক্রামক রোগগুলো কমে এলেও বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। যেমন_ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপ। এর কারণ অতিরিক্ত ব্যস্ততা, ফাস্টফুডে আসক্তি, অতিরিক্ত টেনশন, কোমল পানীয় পান, শ্রমবিমুখ মানসিকতা, তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ ইত্যাদি।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ
কারণ ধরে উচ্চ রক্তচাপকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি। প্রাইমারি কারণগুলো এখনো অজানা। মজার ব্যাপার হলো, সিংহ ভাগ উচ্চ রক্তচাপের কারণ এখনো জানা যায়নি। অল্প কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কারণ জানা যায়। যেমন_কিডনির কিছু সমস্যা, হরমোনজনিত সমস্যা ইত্যাদি। সেকেন্ডারি রক্তচাপ বলে সেগুলোকে, যার কারণ জানা যায়। যেমন_ধমনিগাত্র সরু হয়ে যাওয়া।
উপসর্গ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা দেখা দিলে কেবল তখনই কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন_মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা হঠাৎ টলে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

চিকিৎসা
চিকিৎসকরা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছেন। প্রথম দিকে চীনা চিকিৎসকরা উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসায় আকুপাংচার পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। অনেক দেশে তখন রোগীরা শরীর কেটে রক্ত বের করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ওষুধ দিয়ে পায়খানার পরিমাণ বাড়িয়েও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিজ্ঞানীরা সফলভাবে নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এখন ডাক্তাররা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা সাধারণত দুভাবে করেন। ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা এবং জীবনযাপনের পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে চিকিৎসা। বর্তমানে বাজারে বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয় বলে এসব ওষুধের দাম অনেক কম। তা ছাড়া প্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত হওয়ায় এসব ওষুধ সারা জীবন গ্রহণ করলেও কোনো সমস্যা হয় না। একেকজনের শারীরিক অবস্থাভেদে একেক ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে ভালো হলো জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তন করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা। এর মধ্যে রয়েছে চর্বি-জাতীয় খাবার পরিহার, কায়িক পরিশ্রম বাড়ানো, টেনশন কমিয়ে ফেলা, ধূমপান পরিহার করা, প্রচুর শাকসবজি খাওয়া, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা ইত্যাদি। এ সব কিছু করার পরও যদি হাইপারটেনশন না কমে, তাহলে ওষুধ খাওয়া ছাড়া আর বিকল্প থাকবে না।

উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা
উচ্চ রক্তচাপ নিজে যেহেতু কোনো উপসর্গ তৈরি করে না, তাই নীরবে এটি অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের ফলে স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক, কিডনি ফেইলিওর, অন্ধত্বসহ রক্তনালির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে। এসব সমস্যায় কেউ আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় যখন উপনীত হন, তখন জানতে পারেন তিনি আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।

হাইপারটেনশন সেন্টার
বাংলাদেশের উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের চিকিৎসা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম এগিয়ে আসেন মরহুম অধ্যাপক ডা. এস জি এম চৌধুরী। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৮৩ সালে বেসরকারিভাবে প্রথম হাইপারটেনশন সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায়। এখানে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠান এখনো কাজ করছে। ঢাকার বাইরে ২০০৮ সালে রংপুরে আরো একটি হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। ডা. ওয়াছিম-ওয়ালেদা বহুমুখী কল্যাণ ফাউন্ডেশন পরিচালিত অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান এটি।
হাইপারটেনশন সেন্টার তৈরির উদ্দেশ্য হলো এক ছাতার নিচে হাইপারটেনশন রোগীদের নামমাত্র মূল্যে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। হাইপারটেনশন সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য এসব সেন্টার থেকে বিভিন্ন সময় বৈজ্ঞানিক আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, ফ্রি রক্তচাপ পরিমাপ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। ধনী-গরিব নির্বেশেষে সবার চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ থাকায় সারা দেশে এ ধরনের হাইপারটেনশন সেন্টার স্থাপন করা জরুরি।

লেখক : অনারারি পরিচালক
হাইপারটেনশন সেন্টার, রংপুর
অনুলিখন : ডা. সাকলায়েন রাসেল

উচ্চ রক্তচাপ ও কিছু ভুল ধারণা

- অনেকে মনে করেন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ একবার খেলে সারা জীবন খেতে হবে, তাই অনেক রোগী ওষুধ খেতে চান না। এটা ঠিক নয়। কেননা শরীর যদি নিজে থেকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে অবশ্যই ওষুধের সাহায্য নিতে হবে। অন্যথায় আপনি বিলম্ব করলেও বাড়তি রক্তচাপ আপনার ক্ষতিসাধন করতে মোটেও বিলম্ব করবে না।
- কাঁচা লবণ খেলে প্রেশার বাড়ে, তাই লবণ ভেজে খাওয়া ভালো। এটাও একদম ভুল কথা। লবণ ভেজে খান আর তরকারিতে খান, মাথাপিছু প্রতিদিন গৃহীত লবণের পরিমাণ যেন ছয় গ্রাম বা পূর্ণ এক চামচের বেশি না হয়।
- প্রেশার কমে গেলে ওষুধ ছেড়ে দেওয়ায় কোনো ক্ষতি নেই_এটাও একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। মনে রাখতে হবে, ওষুধ খেয়েই প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আছে। তাই ওষুধ ছেড়ে দেওয়া মানেই স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেওয়া।
- একবার প্রেশার বেশি পাওয়া মানেই যে প্রেশারের রোগী_তা কিন্তু নয়। পর পর তিন দিন সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় যদি প্রেশার বেশি পাওয়া যায়, তবে ধরে নিতে হবে আপনার প্রেশার বেশি। নানা কারণে হঠাৎ এক-আধটু প্রেশার বাড়তে পারে। তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগী বলতে হলে প্রেশার পর পর তিন দিন মাপাতে হবে।
- ঘাড়ে ব্যথা মানেই প্রেশার। কখনোই না। কারণ নানা কারণে ঘাড়ে ব্যথা হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই প্রেশারের আধিক্যে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।

মেডিকেল বই এর সমস্ত সংগ্রহ - এখানে দেখুন
Medical Guideline Books


Re: অনেক অসুখের কারণ উচ্চ রক্তচাপ

অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম,
ধন্যবাদ ডাঃ শামীম'কে ।

একজন মানুষের জীবন হচ্ছে~ক্ষুদ্র আনন্দের সঞ্চয়,একেকজন মানুষের আনন্দ একেক রকম...http://www.rongmohol.com/uploads/1805_adda_logo_4.gif

গনযোগাযোগ সচিবঃ ফাউন্ডেশন ফর ওপেন সোর্স সলিউশনস বাংলাদেশ, নীতি নির্ধারকঃ মুক্ত প্রযুক্তি।


Re: অনেক অসুখের কারণ উচ্চ রক্তচাপ

অনেক কাজের পোষ্ট । ধন্যবাদ সাথে রেপু+  :ইয়াহু:  :ইয়াহু:



Re: অনেক অসুখের কারণ উচ্চ রক্তচাপ

শামীম সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ। আমি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি। নিয়মিত ঔষধ সেবন করছি। তথ্যবহুল পোস্টের জন্য আবারও ধন্যবাদ। উচ্চ রক্তচাপের উপর আরও লেখা আশা করছি।