Topic: বেগবান মুক্ত সফটওয়্যার চর্চা
মুক্ত সফটওয়্যার এখন বেশ জনপ্রিয়। দুনিয়া জুড়েই।বাংলাদেশেও বেড়েছে এর ব্যবহার। মুক্ত সফটওয়্যারের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার দেশের ইন্টারনেট সংযোগদাতা ও নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠানে। কম্পিউটারে বাংলা চর্চার ক্ষেত্রেও এগিয়ে মুক্ত সফটওয়্যার।
বিভিন্ন প্রোগ্রামিং সংকেত ব্যবহার করে কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি হয়। এই সংকেত অন্যের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকে মুক্ত সফটওয়্যারে। ফলে যেকোনো সফটওয়্যারকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) মূল স্থানীয়ভাবে মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সচেতনতা তৈরি কাজটাও করছে। ২৩ অক্টোবর ছিল বিওএসএনের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বলা চলে বাংলাদেশে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারের সফল আন্দোলনের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো।
মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলন
মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনের পুরোধা, মুক্ত সফটওয়্যার ফাউন্ডেশনের জনক রিচার্ড ম্যাথিউ স্টলম্যান। যিনি আরএমএস নামে পরিচিত। তিনি সফটওয়্যারের মুক্ত দর্শন নিয়ে কাজ করেন। মুক্ত দর্শনের বড় একটি উদাহরণ উইকিপিডিয়া, যার পরিচিতি গণমানুষের বিশ্বকোষ হিসেবে। শুরুতে রিচার্ড স্টলম্যান বিশ্বকোষ তৈরির প্রস্তাব দিলেও জিমি ওয়ালেসের হাত ধরে বিকশিত হয়েছে আজকের উইকিপিডিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৭৬টি ভাষার মধ্যে বাংলা উইকিপিডিয়াও (bn.wikipedia.org) এখন বেশ সমৃদ্ধ।
বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রশাসক বেলায়েত হোসেন বলেন, বাংলা উইকিপিডিয়া ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং বর্তমানে নিবন্ধের সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার। ব্যবহারকারী যেমন বাড়ছে, তেমনি ভুক্তির মানও বাড়ছে বলে জানান তিনি। উইকিপিডিয়া মুক্ত সোর্স প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল ও জনপ্রিয়। এ সাইটের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটির মতো।
বর্তমানে মুক্ত সফটওয়্যারের আওতায় বেড়েছে স্থানীয়করনের (লোকালাইজেশন) কাজ। অর্থাৎ বিভিন্ন কার্যক্রম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিজস্ব ভাষায় করা। সে কাজটিও এগিয়ে চলছে এবং বর্তমানে বাংলা ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়ার জনপ্রিয় সফটওয়্যার থেকে শুরু করে অনেক কিছু।
রায়ানস আর্কাইভসের প্রধান নির্বাহী আহমেদ হাসান বলেন, মুক্ত সফটওয়্যার বিষয়ে সচেতনতা বেশ বেড়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মুক্ত সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ানোর ব্যাপারে কাজ করা উচিত।
মুক্ত সফটওয়্যারের শুরুর কথা
ওপেন সোর্স বা উন্মুক্ত প্রোগ্রামিং সংকেত ধারণা নতুন নয়। ১৯৫০ সালের দিকে ইন্টারন্যাশনালবিজনেস মেশিনস (আইবিএম) করপোরেশন তাদের অপারেটিং সিস্টেম ও অন্যান্য সফটওয়্যারের প্রোগ্রামিং সংকেত সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ওপেন সোর্সের বিকাশ হয়েছে মূলত প্রোপ্রাইটরি বা স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যার ব্যবহার ও বিতরণের অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু নিয়মনীতির কারণে। স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যারগুলোর সোর্স কোড গোপন রাখা হয়। ফলে সফটওয়্যারে কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা যায় না।কোনো প্রয়োজনীয় উপাদান যুক্ত করারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অপরদিকে মুক্ত সফটওয়্যারের এ রকম কোনো সমস্যা নেই। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ফ্রি সফটওয়্যার থেকে মুক্ত (ওপেন সোর্স) সফটওয়্যার কথার প্রচলন শুরু হয়। ফ্রি বললে সেটি অনেক সময়ই বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়, যদিও ‘ফ্রি’ এসেছে ইংরেজি ফ্রিডম থেকে। স্টলম্যান সফটওয়্যারের চার ধরনের মুক্তির কথা বলেন; যার মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার নিজের পছন্দমতো ব্যবহারের সুযোগ থাকতে হবে, এর সোর্স কোড দেখা এবং সম্পাদনার অধিকার, সফটওয়্যারের পুনর্বিতরণের সুযোগ ও এটি থেকে নতুন কোনো সফটওয়্যার তৈরি করে তা নিজের মতো করে ব্যবহার, বিতরণ ও বিক্রির সুযোগ থাকতে হবে।
বাংলাদেশে মুক্ত সফটওয়্যার কার্যক্রম
মুক্ত সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা বিডিওএসএন সম্প্রতি ছয় বছরে পা দিয়েছে। যাত্রা শুরুর পর থেকেই স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনটি সারা দেশে মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনে কাজ করে যাচ্ছে। বিডিওএসএনের সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আগের চেয়ে মুক্ত সফটওয়্যারের ব্যবহার বেড়েছে। তবে ঠিক যেভাবে বাড়া উচিত, সেভাবে বেড়ে যায়নি। যখন লাইসেন্স ছাড়া সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে না, তখন কেনা ছাড়া সফটওয়্যারও পাওয়া যাবে না।ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে তাই আগে থেকেই মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারের দিকে যেতে হবে।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে, যাতে সর্বত্র এর ব্যবহার ছড়িয়ে যায়। পাশাপাশি নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে এ সফটওয়্যার ব্যবহারে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য।
বিডিওএসএনের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, ‘মুক্ত সফটওয়্যার সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিডিওএসএনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হলো এর অনলাইন সেবা। এর মাধ্যমে যে কেউ মুক্ত সফটওয়্যার-সংক্রান্ত সেবা ই-মেইলের মাধ্যমে পাবেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যেক জেলার জন্য তৈরি ওয়েবসাইট ‘জেলা তথ্য বাতায়ন’ বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় ওয়েব পোর্টালসহ বেশির ভাগ সরকারি ওয়েবসাইটে ব্যবহূত হয়েছে মুক্ত সফটওয়্যার। এ ছাড়া জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) নীতিমালা, ২০০৯-এ মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারটিও যুক্ত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে মুক্ত সফটওয়্যারের ব্যবহারকে আরও কার্যকর করে তোলার কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। মুক্ত সফটওয়্যার দিয়ে স্বাধীন পেশাজীবী হিসেবে এখন অনেক তরুণই কাজ করছেন। এটাও এ আন্দোলনের সফলতা। বর্তমানে এ কাজে প্রায় তিন সহস্রাধিক কর্মী যুক্ত আছেন। মুক্ত পেশাজীবী ওয়েবক্র্যাফট বাংলাদেশের পরিচালক জাকারিয়া চৌধুরী বলেন, কয়েক বছর আগেও স্বাধীন পেশাজীবী হিসেবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের অবস্থান তেমন শক্ত ছিল না। তবে এখন এর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং অনেকেই এ কাজটিকেই পেশা হিসেবে নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে এ কাজের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিভিন্ন ধরনের জনপ্রিয় সফটওয়্যারে বাংলা ভাষায় কার করার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে মুক্ত সফটওয়্যারের কারণে।অংকুর ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহে আলম খান বলেন, বিভিন্ন ধরনের মুক্ত সফটওয়্যারের বাংলা লোকালাইজেশনের কাজ পূর্ণাঙ্গ হয়েছে এবং বেশ কয়েকটির কাজ চলছে। পাশাপাশি বর্তমানে উবুন্টু অপারেটিং সিস্টেম পুরোপুরিভাবে বাংলায় করার কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।
‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এখন মুক্ত সফটওয়্যারের জয়জয়কার বলা যায়। মোবাইল, কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বাড়ছে, যা সত্যিই ভালো খবর’, বললেন বিডিকম অনলাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আহমেদ।
নানা কাজে মুক্ত দর্শন
শুধু সফটওয়্যার ব্যবহারেই নয়, নানা কাজে বর্তমানে মুক্ত দর্শনের ব্যাপারটি প্রচলিত আছে। যারা মুক্ত সাংবাদিকতা করতে আগ্রহী, তাদের জন্য রয়েছে ব্লগ, ফোরাম বা সামাজিক যোগাযোগের সাইট, যেখানে ব্যবহারকারীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা ঘটনার খবর খুব দ্রুত প্রকাশিত হয় এখানে। বেশ কিছু সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট রয়েছে, যেগুলো সম্পূর্ণরূপে মুক্ত সাংবাদিকতার ওপর নির্ভরশীল। রয়েছে বিজ্ঞান এবং গবেষণা বিষয়ে উন্মুক্ত দর্শন। আগের ধারণা অনুযায়ী, সম্পূর্ণরূপে সাফল্য লাভের পর প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানের গবেষণাসংক্রান্ত কাজ এত দিন অত্যন্ত গোপনে রাখা হতো। বর্তমানে মুক্ত দর্শনের দুনিয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে এ ধারণা। এখন ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক গবেষণার প্রাথমিক দিকগুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনা করা হয়, যাতে গবেষণার কাজটিতে সবাই সহযোগিতা করতে পারে। পাঠ্যপুস্তক কিংবা শিক্ষাবিষয়ক উপাদানের ক্ষেত্রেও এখন মুক্ত দর্শন বেশ জনপ্রিয়। মুক্ত সোর্স প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে সিলেবাস, শিক্ষাকার্যক্রম ইত্যাদি বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। বিশ্বের সেরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় মুক্ত সোর্সওয়্যারের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এ ছাড়া মুক্ত দর্শনের মাধ্যমে বর্তমানে বিভিন্ন প্রকাশনাও প্রকাশিত হচ্ছে। এসবের মধ্যে স্বত্বত্যাগ (কপি লেফট) ও সৃৃজনী সাধারণ (ক্রিয়েটিভ কমনস) লাইসেন্স ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে।
মুক্ত সফটওয়্যার পাওয়া যায় ডিজিটালজগতে স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বাদ। নিজের ভাষা নিজের দেশের উপযোগী কাজের জন্য মুক্ত সফটওয়্যার সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।তাই এর প্রসার বাড়ুক, এটাই প্রত্যাশা।
মুক্ত দর্শনের সফলতা
উইকিপিডিয়া: জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব তথ্য একই স্থানে সংকলন করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শুরু করা এই অনলাইন বিশ্বকোষটি অংশগ্রহণকারীর অবদানের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। বর্তমানে উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধের সংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখ।
প্রজেক্ট গুটেনবার্গ: বেশ অনেক দিন আগে থেকে চালু হওয়া এই প্রকল্পটি অনলাইন মুক্ত গ্রন্থাগারের প্রথম উদাহরণ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বিনা মূল্যে বইয়ের ইলেকট্রনিক সংস্করণ বিতরণের সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে ৩৩ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে।
লিনাক্স: সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম।
অ্যানড্রয়েড: অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন চালানোর মুক্ত সফটওয়্যার। গুগল এই প্রকল্পটি চালু করেছে।
মোজিলা ফায়ারফক্স: অন্যতম সফল মুক্ত সোর্স প্রকল্প। ওয়েব ব্রাউজারের ব্যবহারকারীদের জনপ্রিয়তার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এটি। ওপেন অফিস ডট অর্গ: কম্পিউটারে ব্যবহূত দৈনন্দিন সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে ওপন অফিস বেশ জনপ্রিয়।
Medical Guideline Books