Topic: বুলবুল আহমেদ চলে গেলেন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবদাস' উপন্যাসের দেবদাসের পরিণতি কাঁদিয়েছে পাঠককে। চাষী নজরুল ইসলামের হাত ধরে সেই দেবদাস উঠে এলেন রুপালি পর্দায়, আবারও দর্শক কাঁদলেন। বুলবুল আহমেদকে চিনলেন দেবদাস হিসেবে। সেই দেবদাস বুলবুল আহমেদ আবারও কাঁদালেন ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের। এবার চিরবিদায় নিলেন তিনি। ১৪ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন বুলবুল আহমেদ_বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি এক নায়ক। বুলবুল আহমেদ হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত ১৯ জানুয়ারি গুরুতর অসুস্থ হয়ে তিনি স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যান। এরও আগে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সে সময় তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে চিকিৎসকদের চেষ্টায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৪ জুলাই রাতের খাবার শেষে অসুস্থ বোধ করছিলেন বুলবুল আহমেদ। স্ত্রী ডেইজি আহমেদকে বললেন এক কাপ চা করে দিতে। আশা করেছিলেন, চা খেলে বোধ হয় কিছুটা সুস্থ বোধ করবেন। কিন্তু চা-টুকুও শেষ করতে পারেননি তিনি। তার আগেই অচেতন হয়ে পড়েন। দ্রুত স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার বুলবুল আহমেদকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। বুলবুল আহমেদ স্ত্রী, এক ছেলে শুভ, দুই মেয়ে তিলোত্তমা ও ঐন্দ্রিলাসহ অগণিত ভক্ত, সহশিল্পী ও কলাকুশলী রেখে গেছেন। ডেইজি আহমেদ ও ঐন্দ্রিলা অভিনয়শিল্পী। শুভ ও তিলোত্তমা থাকেন দেশের বাইরে। বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে তাঁরা দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। আজ তাঁরা দেশে পেঁৗছানোর কথা। বুলবুল আহমেদের দেহ আজ বিকেল ৩টায় এফডিসিতে আনা হবে। সেখানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাঁকে নেওয়া হবে রামপুরার বিটিভি ভবনে। সেখানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে তাঁকে নেওয়া হবে গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে আরো একবার জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে বুলবুল আহমেদকে দাফন করা হবে।
বুলবুল আহমেদের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায়। ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স করা বুলবুল আহমেদের সুনাম ছিল মেধাবী ছাত্র হিসেবে। মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয়জগতে পা রাখলেও ১৯৭৩ সালে ইউসুফ জহির পরিচালিত 'ইয়ে করে বিয়ে' ছবির মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তাঁর অভিষেক। এর আগে তিনি জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর প্রকৃত নাম তোবাররুক আহমেদ। চলচ্চিত্রে অভিষেকের পর তিনি বুলবুল আহমেদ নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে আলমগীর কবীর পরিচালিত 'সীমানা পেরিয়ে' ছবিতে অভিনয় করে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন কাজী জহির পরিচালিত 'বধূ বিদায়' (১৯৭৮), আজিজুর রহমান বুলি পরিচালিত 'শেষ উত্তর' (১৯৮০) ছবিতে অভিনয় করে। নিজের প্রযোজনায় 'রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত' ছবির মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান তিনি। বুলবুল আহমেদ অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে 'দেবদাস', 'মহানায়ক', 'জন্ম থেকে জ্বলছি', 'সূর্যকন্যা', 'জীবন নিয়ে জুয়া', 'শেষ উত্তর', 'কলমীলতা', 'এখনই সময়', দ্য ফাদার', 'রাইভ ইন আমেরিকা', 'শহর থেকে দূরে', 'শুভদা' ইত্যাদি। জীবদ্দশায় তিনি শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া তিনি বিজ্ঞাপন ও টিভি নাটকের নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন। মৃত্যুর আগে বুলবুল আহমেদ পরিচালিত শেষ ধারাবাহিক নাটক 'বাবার বাড়ি'। তাঁর মৃত্যুতে চলচ্চিত্র, টিভিসহ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতার শোক
খ্যাতিমান অভিনেতা বুলবুল আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাঁরা এই কীর্তিমান অভিনেতার আত্দার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বলেন, বুলবুল আহমেদ অভিনয়জগতে অতুলনীয় প্রতিভা ছিলেন। দেশে সুস্থ চলচ্চিত্রের বিকাশে তিনি অনেক অবদান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব ও দক্ষ অভিনেতাকে হারাল। বুলবুল আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বার্তায় তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রক্ষেত্রে প্রয়াত এই অভিনেতার অবদানের কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুলবুল আহমেদের মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি মরহুমের আত্দার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এক শোকবার্তায় বলেছেন, বুলবুল আহমেদের মতো একজন সৃজনশীল অভিনেতার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া দেশের অভিনয়শিল্পী সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও নাট্য অভিনেতা বুলবুল আহমেদের মৃত্যুতে জাতি একজন একনিষ্ঠ চিত্রাভিনেতাকে হারাল। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেতার মৃত্যুতে সামাজিক অসংগতি চলচ্চিত্রে চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
বুলবুল আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম বলেছেন, "বুলবুল আহমেদ মারা গেছেন, এটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সমস্ত অনুপ্রেরণার পেছনে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর দুই মাস আগেও তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন তিনি 'দেবদাস' ছবি নিয়ে নানা ধরনের স্মৃতিচারণা করলেন। আমি বুঝতেই পারিনি, এটাই হবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। আমার নতুন 'দেবদাস' ছবিতেও তিনি অভিনয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আমিও ভেবেছিলাম, একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করিয়ে তাঁকে একটা সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু সেই সারপ্রাইজটা দেওয়া হলো না।"
নায়ক রাজ্জাক বলেন, "বাবুল আহমেদের 'সেতু' ছবির মাধ্যমে বুলবুল আহমেদের সঙ্গে প্রথম অভিনয়। সেই থেকে তিনি আমার দীর্ঘদিনের সহযাত্রী ছিলেন। কয়েক দিন আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম দেখা করতে। সেদিন বুলবুল আহমেদ আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে'। তাঁর কণ্ঠে এই গান শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। চলচ্চিত্র জগতে সবাই তাঁকে জেন্টল হিরো ডাকত। তাঁর মতো একজন নায়ক আর কখনোই পাব না আমরা।"
চিত্রনায়িকা কবরী বলেন, "বুলবুল আহমেদকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। তিনিও আমাকে সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন। আমি তাঁর অভিনয়ের ভীষণ ভক্ত। এখনো অবসরে ছবি দেখতে বসলে মাঝেমধ্যেই 'দেবদাস' দেখি। তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হই। তাঁর এই চলে যাওয়া সত্যি কষ্টের; এই কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না।" আমজাদ হোসেন বলেন, "ইন্ডাস্ট্রিতে তিনিই ছিলেন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। এত বড়মাপের অভিনেতা আমার চোখে পড়েনি। আমার 'জন্ম থেকে জ্বলছি' ছবির 'জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো' গানটি গাওয়ার সময় তিনি গি্লসারিন ছাড়াই কেঁদে দিয়েছিলেন। এত আবেগী অভিনেতা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আর একটিও নেই।" চিত্রনায়িকা সুচরিতা বলেন, 'তাঁকে দেখতে যাব যাব করেও যাওয়া হলো না। তার আগেই তিনি চলে গেলেন। খুব খারাপ লাগছে তাঁর মতো একজন মানুষকে হারিয়ে।' বুলবুল আহমেদের মৃত্যুতে আরো শোক প্রকাশ করেছে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা, বিশ্ব কবিতাকণ্ঠ পরিষদ, মাছরাঙা টেলিভিশন ও জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ।
সূত্র : এখানে