Topic: ওলা বিবি
(গুরুর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক নিবেদন)
বরের বাপ সবুর করিতে পারিতেন,কিন্তু কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিলেন না, কেননা ইতিমধ্যে তাঁহার পঞ্চম বিবাহের বয়স পার হইয়া যাইতেছে। তাছাড়াও কন্যার বয়সও অবৈধ রকমভাবে বাড়িয়াছে, ফলে দূর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিবার আশংকাও একেবারে উড়িয়া দেওয়া যায় না।
আমি ছিলাম বর! সুতরাং আমার মত যাচাই করিবার আবশ্যকতা ছিল না। আমার কাজ আমি করিয়াছি, গ্রামীন ব্যাংক হইতে লোন তুলিয়া একখানা ভ্যান কিনিয়াছি। পাত্র উপার্জনক্ষম এবং পন বেশি পাওয়া যাইবে, তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ , কন্যা পক্ষ ও বরপক্ষ ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল।
সত্য বলিতেছি, আমার মনে বিশেষ কোন উদ্বেগ জন্মে নাই। বরং রোমাঞ্চ অনুভব করিয়াছি, কৌতুহলী কল্পনার কিশয়গুলির মধ্যে যেন একটু হাতাহাতি ভাব খেলিয়া গেল। যাহাকে প্রতিদিন নুন্যতম পঞ্চাশ মাইল ভ্যান চালানোর স্বাদ উপভোগ করিতে হইবে তাহার পক্ষে এ ভাবাটা দোষের। আমার এ লেখা যদি ব্লগে প্রকাশিত হইবার ভয় থাকিত তবে একটু সাবধান হইতাম।
কিন্তু এ আমি কি করিতেছি! একটা গান লিখিতে বসিয়া উপন্যাস লিখিতেছি। এমন সুরে লেখা আরম্ভ হইবে তাহা কি আগে জানিতাম? মনের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ জন্মিয়াছে তাহাকে বৈশাখ সন্ধ্যার ঝোড়ো বৃষ্টির মত প্রবল বর্ষণে নিঃশেষ করিয়া দিব, না পারিলাম গীতিকার হইতে, না পারিলাম হারপিক ওয়ান প্রতিযোগীতার গায়ক হইতে যাহাতে মনের দুঃখগুলো গান আকারে ভিতর হইতে বাহির করিয়া আনিয়া জনসন্মুখে প্রকাশ করিব। সেই জন্য আমার মধ্যকার অশ্রুহীন,হতভাগা,শ্মশানচারী সন্যাসিটা অট্টহাস্যে আপনাকে আপনি প্রহার করিতেছে।
আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না কারন, কোন মানুষই তাঁহার নিজ সন্তানের জন্য ঐ নামটা রাখিবার জন্য পরষ্পরের সহিত রক্তপাতে লিপ্ত হইবে না। তাছাড়া তাহার নামটি লইয়া কোন প্রকার সিনেমা, থিয়েটার প্রস্তুত হইবার সম্ভাবনাও নাই। তাহার নাম বিশেষ রঙের হরফে আমার মনের মধ্যে খোদাই করা আছে।
আমার এ লেখায় তাহার একটি নাম থাকা চাই। আচ্ছা তাহার নাম দিলাম ওলা বিবি, কেননা যে স্বপ্ন হইয়া কাছে আসে আবার শরীরের সমস্ত শক্তি হরণ করিয়া মরিচীকার মত অদৃশ্য হইয়া যায় সেই ওলা বিবির কথাটা বারবার মনে করাইয়া দেয়।
ওলা বিবি আমার চেয়ে কেবল ছয় বছরের বড় ছিল। অথচ আমার পিতা যে প্রৌঢ়া দানের পক্ষপাতি ছিলেন, তাহা নহে। তাহার পিতা ও আমার পিতা্র মধ্যে স্বভাবে যথেষ্ঠ মিল ছিল। তবে আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজ বিদ্রোহী, মানিতে তাঁহার বাধে এমন জিনিস অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কিতে খুঁজিয়া পাওয়া দায়। কোন মতামতই সরল স্বাভাবিক নহে, তবুও বড় বয়সের মেয়ের সাথে ছেলের বিবাহ দিলেন কারন , মেয়ের বয়স বড় বলিয়া যৌতুকের অংকটাও বড়। ওলা বিবি আমার শ্বশুরের দ্বাদশতম ও কনিষ্টতম স্নেহশীলা কন্যা। বাবার বিশ্বাস ছিল এই স্নেহশীলার কল্যানেই তাহার বাবা ভাবী জামাতার অনন্ত চাহিদাকে পূরণ করিতে সচেষ্ট হইবেন।
সবেমাত্র বাইশ-এ পা দিয়াছি , এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজ সংস্কারকের মতে উপযুক্ত কিনা তাহা লইয়া দুইপক্ষ গোলাগুলি করিয়া গুলিবিদ্ধ হইয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি ,সে বয়সটা তারুণ্য দিয়া অর্থ উপার্জনের পক্ষে যত ভালই হউক, বিবাহের সন্মন্ধ আসিবার পক্ষে কম ভাল নয়।
বিবাহ নামক তামাশার সূচনা হইল আমার এক সহকর্মীর একখানি ফটো লইয়া মস্করার মাধ্যমে। সে একদিন আমার হাতে ওলা বিবির ছবিখানি গুঁজিয়া দিয়া কহিল, “এইবার সত্যিকারের রোজগার কর, একেবারে রক্ত-মাংস পানি করিয়া কর।”
কোন এক চাটুকার গোছের কারিগরের তোলা ছবি। সুতরাং তাহার মাথার কিছু অংশ কাটিয়া গিয়াছে ফলে চুল আছে কিনা সে সন্মন্ধে ভাবনার উদয় হইল। পায়ে হাইহিল জুতা,শাড়ী,মুখে বিছাপোকার মত লালটুকটুক লিপিস্টিক, দুইনলা বন্দুকের মত নাক, সুবিশাল বক্ষ ইত্যাদি লইয়া যে কি অবস্থা সে আমি বলিতে পারিব না। আমি আশ্চর্য হইলাম ইহাতে বাংলা ছবির নায়িকার মত শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট পরিয়া বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করা হয় নাই। পটের ছবিটির উপর আমার মনের লৌহ কাঠি লাগিতেই তাহার বিশেষ ভাবের মুখখানা আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল।
যাহা হউক চার-পাঁচটা বিবাহের লগ্ন পিছাইবার পর শুভ মূহুর্ত উপস্থিত হইল। সে দিনের প্রতিটি মুহুর্ত আমার জীবনে এখনও বিষফোঁড়া হইয়া আছে।
ব
িবাহসভার চারদিক হট্টগোল; তাহারই মাঝে কন্যার সুপ্রশস্ত খসখসে হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল। এমন আশ্চর্য আর কি আছে, ছোটকালে সাপ দেখিয়াও এমন ভয় পাই নাই । আমার বারংবার মনে হইতে লাগিল, ইহা খাইল আমাকে,খাইল আমাকে। এ যে সস্তা, ইহাই যে মানবী-দানবী, ইহার বহুরূপতার কি অন্ত আছে?
কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পুর্বে আমার শ্বশুর আমাকে বলিলেন, “বাছা যে জিনিস তোমাকে দিলাম তাকে যেন নিয়ন্ত্রণ করিতে পার।”
তাহার পরে তিনি মেয়ের কাছে গিয়া বলিলেন, “বালিকা চলিলাম, তোর একখানি বাপ, আজ হইতে ইহা যদি অন্য কারো সাথে বিনিসূতার বন্ধনে আবদ্ধ হয় বা কোন কিছু খোয়া যায় তার জন্য আমি দায়ী নই।”
শেষে পিতা তাঁহার কন্যাকে নিজের নফস সংযত রাখিতে বলিলেন।
অবশেষে শ্বশুর মশাই আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া ধমকের সুরে বলিলেন, “ আমার মেয়েটির বড়ই চাইনিজ, ফাস্টফুড খাইবার শখ, মাঝে মাঝে কাটপিসওয়ালা ছিনেমা দেখিতে ও বড় ভালবাসে, স্কুলের মেয়েদের যেমন উপবৃত্তি দেয়া হয় তেমনি আমি তোমাকে প্রতিমাসে ভাতা পাঠাইব, বেহাই জানিতে পারিলে রাগ করিবেন না তো ?”
আমি কিছু আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ব্যাটা গোবর গণেশ বলে কি, সংসারে কোন দিক হইতে অর্থসমাগম ঘটিলে বাবা রাগ করিবেন তাহাকে তো এমন রাগী কখনও দেখি নাই। যেন ঘুষ দিতেছেন এমনিভাবে আমার হাতে আটখানা অর্ধশত টাকার নোট গুঁজিয়া দিয়া তিনি সদর্পে প্রস্থান করিলেন।
আমি স্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিলাম,“ ইহারা আবার কোন জাতের মানুষ।
বন্ধুদের তো অনেককেই বিবাহ করিতে দেখিলাম। মন্ত্র পড়ার সাথে সাথেই স্ত্রীটিকে একগ্রাসে গলধঃকরণ করা হয়। আমি বিবাহ সভাতেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, প্রথম দিনেই স্ত্রীকে গ্রাস করিব না। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারনেই পরে আমাকে চরম মাশুল দিতে হইয়াছিল। আমি হাড়ে হাড়ে টের পাইয়াছি, সে আমার বিপদ নয়, সে আমার আপদ
‘ওলা বিবি’! না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না। একে তো এটা তাহার নাম নহে তাহার উপরে সে বিষফোঁড়ার মত ধ্রুব সত্য , সে ক্ষণবাসিনী, বর্ষার বিদায়ের শেষ অশ্রু বিন্দুটি নয়। কি হইবে গোপন রাখিয়া, তাহার আসল নাম মনিরা।
দেখিলাম এই আটাশ বছরের মেয়েটির উপর যৌবনের কামদৈত্য আসিয়া পুরাপুরি ভর করিয়াছে, ঠিক যেন মদের বোতল, ঢালিয়া খাইবার অপেক্ষামাত্র কিন্তু এখনো প্রাইমারির গন্ধ যায় নাই। আমার মনে এক ভয় ছিল, গৃহস্থালী কর্ম জানা(আমার ধারনা মতে) বড় বয়সের মেয়ে, কি জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে কে জানে। কিন্তু কিছুদিন বাদেই দেখিলাম, কিছু রূপচর্চার জিনিস পাইয়া মনি আমার বেজায় ভক্ত হইয়া উঠিয়াছে। কবে যে তাহার কালো মনে ধীরে ধীরে রঙ ধরিতে লাগিল, কবে যে তাহার শরীর মন কামনায় বিভোর হইয়া উঠিয়াছে তাহা ঠিক বলিতে পারিব না।
এতো গেল একদিকের কথা। অন্যদিকের কথা বলিবার সময়ও আসিয়াছে। আমার শ্বশুর আন্ডার ওয়ার্ল্ডের গডফাদার (আন্ডার ওয়ার্ল্ড ও গডফাদার শব্দযুগলের অর্থ সে সময় জানিতাম না)। ব্যাংকে যে তাঁহার কত টাকা জমিয়াছে সে সন্মন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার অংকপাত করিয়াছে। কিন্তু আবালবৃদ্ধবনিতা সবার সাপেক্ষে কোন অংকটাই বিলিয়ন ডলারের নিচে নামে নাই। এতো বড় ধনীর দুলালীর সহিত আমার জোড়া হইল কেমন করিয়া তাহা অন্য এক উপাখ্যান। যাহোক পরিবারে আমার শ্বশুরের যেমন কদর বাড়িল তেমনি মনির আদরও হইল ঈর্ষণীয়।
এমনি করিয়াই দিন চলিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু বাবার মুখে একদিন দেখিলাম ঘোর অন্ধকার। ব্যাপারখানা এই যে বাবা তাঁহার এক দালাল বন্ধুর নিকট হইতে জানিতে পারিলেন আমার বিবাহের সময় দেয়া পঞ্চাশ হাজার টাকাই লোন তুলিয়া দেয়া যাহার সাপ্তাহিক কিস্তিও কম নহে আর বিলিয়ন ডলারের তো কোন খবরই নাই।
সম্পদ লইয়া বাবার সহিত তাঁহার বেহাইয়ের কোন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় নাই তবুও বাবা কোন এক লজিকে ঠিক করিলেন বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রতারিত করিয়াছেন।
বাবার একটা ধারনা ছিল আমার শ্বশুর হয়ত বা বড় কোন(ফাইভস্টার) হোটেলের মালিক এবং অন্যান্য ব্যাবসা তো আছেই। খবর লইয়া জানিতে পারিলেন তিনি সেখানকার পাতি মাস্তান। যদিও ইহার পর হইতে বাবা তাঁহার বেহাইকে ভয় করিতে লাগিলেন তথাপিও তাঁহার লোভ ও ক্ষোভ কমিল না। বাবার বড়ই আশা ছিল বেহাইয়ের অনুপস্থিতিতে তিনি হোটেলের মালিকানাপ্রাপ্ত হইবেন।
এমন সময় রাস উপলক্ষ্যে দেশের কুটম্বরা আমাদের বাড়িতে আসিয়া জমা হইতে লাগিল। কন্যাকে দেখিয়া তাহাদের মধ্যে একটা কানাকানি পড়িয়া গেল। এক দিদিমাশ্রেণীয়া কন্যার চুল দেখিয়া বলিলেন , ‘ কি সৌভাগ্য আমার, আমি যে বয়সে নাতবৌয়ের সমান হইলাম” বলিয়া হাসিতে লাগিলেন। কারন মনির চুলেও দু একটা পাক ধরিয়াছিল। অন্য এক ছোট ছেলে ‘বুড়ি বউ, বুড়ি বউ’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। মা ধমকের সুরে বলিলেন, সে কি কথা! বউমার বয়স সবে তো ষোল বৈ ত নয়। আসছে জুনে সতেরই পা দেবে। খোট্টার দেশে চাইনিজ বিরিয়ানি খাইয়া অমন বাড়ন্ত হইয়াছে। দিদিমারা বলিলেন,বাছা খালি চোখে এখনো বস্তুর অণু-পরপাণু গুনিতে পারি আর ছোকরার বয়স তো কোন ছার; কন্যাপক্ষ নিশ্চয় তোমাদের কাছে বয়স ভাঁড়াইয়াছে।
মা বলিলেন, আমরা যে সার্টিফিকেট দেখিলাম। কথাটা সত্য। তবে সার্টিফিকেটেই প্রমাণ আছে মেয়ের বয়স আটাশ।
এই লইয়া ঘোর তর্ক এমন কি বিবাদ হইয়া গেল।
এমন সময় মনি সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোন এক দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন ,নাতবৌ তোমার বয়স কত? মনি বাড়াইয়া কহিল ‘তিরিশ’।
মা ব্যাস্ত হইয়া কহিলেন, তুমি জান না।
মনি কহিল,”আমি জানি, আমার বয়স তিরিশ”
দিদিমারা আনন্দে চুলাচুলি করিলেন।
বধূর নির্বুদ্ধিতায় মা রাগিয়া গিয়া বলিলেন, “তুমি তো সব জান, তোমার বাবা যে কহিলেন তোমার বয়স ষোল।”
মনি চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “বাবা বলিয়াছেন! কখনও না”
মা বলিলেন, অবাক করিলে। বেহাই আমাকে নিজের মুখে বলিলেন আর মেয়ে বলে না। এই বলিয়া আবার চোখ টিপিলেন।
মনি এইবার ইশারার মানে বুঝিল। গলার স্বর চড়া করিয়া সে বলিল, ‘ বাবা এমন কথা কখনই বলিতে পারেন না।’
এইবার মা ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া মনির কান আচ্ছামত মলিয়া দিয়া কহিল, ‘তবে তুই কি আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস ?’
মনি কহিল, ‘আর যাহাই করুক আমার বাবা তো কখনো মিথ্যা বলেন না।’
ইহার পরে মা যতই মনিকে কিল-ঘুষি মারিতে থাকিলেন পরিস্থিতি ততই সাংঘাতিক হইতে লাগিল। মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার বধূর নির্বুদ্ধিতা এবং ততোধিক একগুঁয়েমীর কথা বলিয়া দিলেন।
বাবা মনিকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘ অত্ত বড় বুড়ো গাধীর বয়স তিরিশ এটা কি খুব গৌরবের কথা, তাই মাইকিং করিয়া বেড়াইতে হইবে? আমার এইখানে এইসব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি’। বাবার কথা শুনিয়া মনির মন ভাঙ্গিয়া খানখান হইয়া গেল।
হায়রে! বউমার প্রতি বাবার আকাশচুম্বি ভালবাসা ভুতলে গমন করিল।
বোকামী করা সত্বেও মনিকে সান্ত্বনা দিয়া আমি বলিলাম, ‘ তোমার কার্যে আমি কখনো বাধা দিব না, আমি যে তোমার রূপে বাঁধা।’ শুনিয়া মনি একটু মুখ ভ্যাংচাইল। সেই গুনাবলী স্বয়ং বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোন বর্ণনার দরকার নাই।
একদিন আমাদের বাড়িতে একখানা মুরগী জবাই করা হইল। মা ইহাকে প্রস্তুত করিয়া রান্নার জন্য মনিকে নির্দেশ দিলেন। মনি বলিল, কেমন করিয়া প্রস্তুত করিতে হইবে বলিয়া দাও মা। ইহাতে কাহারও মাথায় পচা ডিম ফাটিবার কথা নহে, ধনীর দুলালী, কুটা ছিঁড়িয়া কখনো দুটা করে নাই। কেবল মনির কর্মদক্ষতা যাচাই করিবার জন্যই এমন আদেশ করা হইয়াছে।
সকলেই গালে হাত দিয়া বলিলেন, ওমা কোন অকর্মার ঘরে ইহার জন্ম ? ইহার পরে পিতাকে কটাক্ষ করিতেই মনি ভীমমূর্তী ধারন করিয়া বলিল, আপনার সকলেই জানেন, সে দেশে সবাই আমার বাবাকে ক্যাডার বলিয়া জানে। কথা শুনিয়া সেইখানে হাসির রোল পড়িয়া গেল।
তাহার পরে মনির বাবার উল্ল্যেখ হইলেই বলা হত ‘তোমার ক্যাডার বাবা’।
অন্তঃপুরে মনির একজন প্রকৃত অনুরাগী ছিল, সে আমার ছোট ভাই গদাধর। ভাবির সহিত অশ্লীল হাসি-তামাশার জন্য ইহাকে কতবার যে পিটানো হইয়াছে তাহার কোন ইয়ত্তা নাই।
বাড়িতে তখন নববধূর অকল্যাণে অশান্তির বাতাস হইতে শুরু করিয়াছে ।
আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু বক্ষিল চন্দ্র রায়, একদিন আমাকে বলিলেন, কি মশায়! বউয়ের সহিত কেমন মজা হইতেছে? আমি মিথ্যা করিয়া বলিলাম- মন্দ না। ইহার পরে জিদ ধরিল সে মনিকে দেখিতে যাইবে। আমি অমত করিলাম না।
নির্ধারিত দিনে বন্ধু উপস্থিত হইল। সবকিছু পূর্ব হইতেই ঠিকঠাক করা ছিল। প্রথমবার বক্ষিল যখন মনির মুখামুখি হইল তখন এমনভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া ছিল যে, সে যেন অমৃতলোকের সন্ধান পাইয়াছে। ইহার পরে আহার ও অনেক গল্প-গুজব হইল। তাহার পর বিদায় জানানোর জন্য আমি বন্ধুর সহিত কিছুদুর গমন করিলাম। বিদায়কালে বক্ষিল আমাকে অত্যন্ত দূর্বল চিত্তে কহিল, দোস্ত ভাবিকে অনেক পছন্দ হইয়াছে।
আমি ভাবিলাম কৈশোরকালে কিশোরেরা যোগ্যতা ছাড়াই বিপরীত লিঙ্গের যে কোন একটির জন্য জীবনবাজি রাখিতে চায় আবার কিশোরীরাও অযোগ্য নির্বোধের হাতে নিজেকে সমর্পন করিতে লজ্জাবোধ করে না। কিন্তু এই অপদার্থ কি দেখিয়া মনিকে পছন্দ করিল তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। যাই হোক আমারই তো বউ! ইহা লইয়া আমি আর বেশি মাথা ঘামাইলাম না।
ইহার পর হইতে নানা ছলে বক্ষিল আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করিতে লাগিল এবং দিনে দিনে মনির প্রয়োজনীয় প্রসাধনী জিনিসের চাহিদা কমিতে আরম্ভ করিল। স্ত্রী আর আমাকে অহেতুক জ্বালাতন করে না দেখিয়া মনে মনে তৃপ্ত হইয়াছিলাম। কিন্তু আমার এই তৃপ্তিই যে একদিন বিষের পেয়ালায় রূপান্তরিত হইবে তাহা কোনদিনও স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারি নাই। বাড়িতে বন্ধুর ঘন ঘন আগমন করার ফলে সবার মনে সন্দেহের বহ্নিরেখা স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইতে লাগিল। এমনিতেই সবার সহিত মনির শীতল সম্পর্ক, তাহার মধ্যে এই অনাকাংখিত ঝামেলা জুটিয়া পরিস্থিতি যেমনটা মারাত্মক করিয়াছিল তেমনি আমাদের বন্ধুত্বের মাঝেও ভাটা পড়িতে লাগিল।
মনি সর্বদা মুখ ভার করিয়া থাকে, আমার সহিতও ভাল করিয়া কথাটি পর্যন্ত বলে না, আগের মত সপ্তাহে আর পাঁচটি সিনেমা দেখিতে যাওয়া হয় না; চারিদিকে শুধু তুষের আগুন আর তুষের আগুন। আটাশ বছর ব্যাপিয়া যে গিরিপথের অধিকারিনী স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষ হইয়াছে সে-ই আজ সামাজিক বাধায় আটকা পড়িয়াছে।
দিনে দিনে মনি হাড্ডিসার হইতে লাগিল তাহা আমরা প্রতিদিনের অভ্যাসবশঃত বুঝিতে পারি নাই। একদিন মাঝরাতে ঘুম হইতে উঠিয়া দেখি বিছানায় মনি নাই, আমার বুকের ভিতরটা ধক করিয়া উঠিল। বাহিরে গিয়া দেখি সে আকাশের পানে চাহিয়া তারা গুনিতেছে আর তাহার কাল্লামোবারকের চুল এলোমেলোভাবে ছড়াইয়া রহিয়াছে।
ইহার কিছুদিন পর বলা নাই কওয়া নাই আমার শ্বশুর আমাদের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। মনির শুকনো চেহারা দেখিয়া প্রথমেই তিনি তুলকালাম কান্ড ঘটাইলেন।“আমার মেয়ের এমন পরিস্থিতি কেন” ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নবানে তিনি বেহাই-বেয়ানকে ধমকাইতে লাগিলেন, বাবার উপস্থিতিতে পূর্ণশক্তি পাইয়া মনিও গর্জিয়া উঠিয়া বলিল, এইবার আমি বাবার সাথে যাইবই, দেখি আমাকে কে আটকায়। তামাশা দেখিতে দু-চারজন লোক পর্যন্ত জমা হইয়া গেল। আমি আর ঠিক থাকিতে পারিলাম না, উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, মনি! বেশি চেঁচামেচি করিলে দড়ি দিয়া তোমাকে বাঁধিয়া রাখিব। বাবা এইবার সাহস পাইলেন। নিজ বাড়িতে যে বেহাই তাঁহাকে ধমক দিয়াছেন তাঁহার উপর তিনি আক্রোশে ফাটিয়া পড়িলেন। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া আমার শ্বশুর নিশ্চুপ হইলেন। অতঃপর বিদায় লইবার জন্য তিনি কন্যার নিকটে গেলেন। কিন্তু মনি হঠাৎ কেন জানি ভর্ৎসনার সুরে বলিল, বাবা আমার জন্য যদি আর কোনদিনও তুমি এমন ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আসো তাহলে বাড়ির পোষা কুকুর ভুলুকে তোমার পেছনে লেলিয়ে দিব। আর বাপ অপমানের হাসি হাসিতেই হাসিতেই বলিলেন, ফের যদি আসি তবে হেভি মেশিনগান সঙ্গে করিয়াই আসিব।
তাহার দুইদিন পরে কর্মক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া যাহা শুনিলাম তাহাতে আমার হৃৎপিন্ডে গ্রেনেড হামলা হইল। আমারই বন্ধু বক্ষিল! আমারই এতো বড় সর্বনাশ করিতে পারে! ক্ষণিকের জন্য আমার সংজ্ঞা লোপ পাইল।
ইহার পর হইতে মনির সেই তরমুজের বিচির ন্যায় দাঁতযুক্ত মুখের হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই।
তাহার পরে যে কান্ডটা ঘটিয়াছে তাহা লজ্জায় এখানে বলিতে পারিব না।
থাক, শুনিতেছি মা পাত্রীর সন্ধান করিতেছেন। হয়তো মার আদেশ একদিন পালন করিব। কারন সে যদি পারে তবে আমার তাহাতে দোষ কি?
এফ এইচ রিগ্যান
২০০৫