Topic: রোজা রেখে ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়

আমরা শরীরের রোগ নিরাময়ের জন্যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওষুধ সেবন বা ব্যবহার করে থাকি, তার মধ্যে একটি অন্যতম পদ্ধতি হলো- ‘ইনজেকশন’। এ ইনজেকশন বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক বিশেষ পদ্ধতি, যা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করছে। কিন্তু কথা হচ্ছে- ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে অন্যতম একটি ভিত্তি হলো- রমযান মাসের রোজা, যেটা উম্মতে হাবীবীর জন্যে ফরজে আইন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তিনি কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো- যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাক্ওয়া হাছিল করতে পার।”
আর হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
“ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি- (১) সাক্ষী দেয়া মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ (মাবূদ) নেই এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আল্লাহ্ পাক-উনার বান্দা ও রসূল। (২) নামায কায়িম করা। (৩) যাকাত আদায় করা। (৪) হজ্ব করা। (৫) রমজান মাসের রোজা রাখা।”
মূলকথা হলো- রমযান মাসের ৩০ দিন বা ২৯ দিন (চাঁদের হিসাব মোতাবেক) রোজা রাখা ফরজ। এটার অস্বীকারকারী কাফির এবং তরক করলে কবীরা গুণাহ্ হবে। অতএব উক্ত ফরজ রোজাগুলো আমাদেরকে সঠিকভাবে আদায় করতে হবে। আর সঠিকভাবে আদায় করতে হলে অবশ্যই তার মাসয়ালা-মাসায়িলগুলো জানতে হবে। অর্থাৎ কি করলে রোজা ভঙ্গ হয়, আর কি করলে রোজা ভঙ্গ হয়না, এ সম্পর্কিত ইলম (জ্ঞান) অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য অর্থাৎ ফরজ।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে,
“প্রত্যেক মুসলমানের (নর ও নারী) জন্যে ইল্ম বা জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।”
অতএব শরীয়ত সম্পর্কিত সকল বিষয়ের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা যেমন ফরজ তদ্রুপ রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে কিনা এ সম্পর্কিত ইলম অর্জন করাও ফরজ। সুতরাং যারা না জেনে রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিবে, তারা এ সম্পর্কিত ইলম অর্জন না করার কারণে ফরজ তরকের গুণাহে গুণাহ্গার হবে।
মূলতঃ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা উনাদের ফিক্বাহের কিতাবসমূহে রোজা ভঙ্গ হওয়া না হওয়ার কারণসমূহ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। তবে সম্প্রতি যে বিষয়টি নিয়ে মুসলিম উম্মাহ্ বেশী সমস্যার সম্মুখীন, তা হলো- রোজা অবস্থায় “ইনজেকশন ব্যবহার করা।” পূর্ববর্তী ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের সময় যেহেতু ইনজেকশনের ব্যবহার ছিলনা, তাই উনারা ইনজেকশন সম্পর্কে কোন আলোচনা করেননি। তবে রোজা ভঙ্গ হওয়া না হওয়ার কারণ বা উছূলগুলো কিতাবসমূহে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে কি হবেনা। ইতিপূর্বে কেউ কেউ ফতওয়া দিয়েছেন যে, “ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়না।” যেমন ইমদাদুল ফতওয়ার ২য় জিঃ ১৫৪নং পৃষ্ঠায়, ২১৯নং সুওয়ালের জাওয়াবে বলা হয়েছে যে, “ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়না।”
অনেকে ইনজেকশন সম্পর্কে এ ফতওয়াকেই দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন এবং এটাকেই ইনজেকশন সম্পর্কে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত বা ফায়সালা মনে করে থাকেন। আর এর উপর ভিত্তি করে বর্তমানে অনেকে ফতওয়া দিচ্ছে যে, রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়না।
ইমদাদুল ফতওয়ার বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে ফতওয়া দেয়ার পূর্বে উচিৎ ছিল ইমদাদুল ফতওয়ার বক্তব্যকে ভালরূপে তাহ্ক্বীক্ব করা। বিনা তাহক্বীক্বে ফতওয়া দেয়ার পরিণামও খুব ভয়াবহ। কেননা হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,
হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তিকে ইলম ব্যতীত ফতওয়া দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে তদানুযায়ী কাজ করেছে, তার গুণাহ্ যে তাকে ফতওয়া দিয়েছে, তার উপরই পড়বে।” (আবু দাউদ শরীফ)
অতএব কেউ যদি কারো ফতওয়ার উপর ভিত্তি করে রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নেয় (আর যেহেতু ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়) তবে রোজা ভঙ্গের গুণাহ্ উক্ত ফতওয়া প্রদানকারীর উপর বর্তাবে। সুতরাং ফতওয়াদানের ব্যাপারে অর্থাৎ বিনা তাহক্বীক্বে বা যাচাই-বাছাই না  করে ফতওয়া দান হতে বিরত থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ঘটনাটি আমাদের জন্যে এক অমূল্য নছীহত, যদি আমরা বুঝি। তাহলো-হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি মালেকী মাযহাবের ইমাম। উনার সীরতগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রথম যেদিন ফতওয়ার মসনদে বসলেন মুফতী হিসেবে, ফতওয়া দেওয়ার জন্য সেদিনই উনার কাছে ৪০টি মাসয়ালা বা সুওয়াল আসলো। তিনি ১৮টির জাওয়াব দিয়েছেন এবং বাকী ২২টির জাওয়াবে বলেছেন, ‘আমি জানি না’ যখন জাওয়াব শেষ হয়ে গেলো এবং সুওয়ালকারীগণ চলে গেলো, তখন উনার নিকটবর্তী যে সকল বড় বড় আলিমগণ বসেছিলেন উনারা বললেন, “হে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি কি সত্যই ঐ ২২টি মাসয়ালার জাওয়াব জানেন না? তখন হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমার জানা আছে, তবে ১৮টি মাসয়ালায় আমার পূর্ণ তাহক্বীক্ব আছে, তাই জাওয়াব দিয়েছি, আর বাকী ২২টি মাসয়ালায় পূর্ণ তাহক্বীক্ব নেই, হতে পারে বর্তমানে ২২টি মাসয়ালা সম্বন্ধে আমার যে ফয়সালা আছে পূর্ণ তাহক্বীক্বের পরে তার ব্যতিক্রমও হতে পারে। এই লোকগুলি অনেক দূর থেকে প্রায় ৬ মাসের রাস্তা অতিক্রম করে আমার কাছে এসেছে মাসয়ালা জানার জন্য। এখন যদি আমি বিনা তাহক্বীক্বে তার জাওয়াব দিয়ে দেই যা পূর্ণ শুদ্ধ নয়, তবে তার ভিত্তিতে তারা আমল শুরু করবে, আর পরে যখন আমার পূর্ণ তাহক্বীক্ব হবে এবং তা যদি বর্তমান ফয়সালার ব্যতিক্রম ফয়সালা হয়, তাহলে তাদেরকে কে এই ফয়সালার বিশুদ্ধ বা পূর্ণ তাহক্বীক্ব সম্বলিত মতটি জানাবে? যেহেতু আমি তাদের বিস্তারিত পরিচয় বা ঠিকানা জানি না। আর এজন্য হয়ত আমাকে মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে জওয়াবদিহী ও পাকড়াও হতে হবে। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন,
“যদি তোমরা না জান, তাহলে যারা জানেন ও অভিজ্ঞ, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে নাও।”
সেজন্য আমি তাদেরকে বলেছি আমি জানি না। অর্থাৎ আমার পূর্ণ তাহক্বীক্ব নেই। যার এ ব্যাপারে পূর্ণ তাহক্বীক্ব আছে, তার কাছ থেকে জেনে নাও।
মূলতঃ ইনজেকশন সম্পর্কে ইমদাদুল ফতওয়ার বক্তব্য শুদ্ধ হয়নি। কারণ হাদীছ শরীফ, ফিক্বাহের কিতাবে বর্ণিত উছূল ও বর্তমান আধুনিক বিশ্বের উন্নততর চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভালরূপে তাহক্বীক্ব বা গবেষণা করার পর এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কারণ ইনজেকশনের দ্বারা প্রবেশকৃত ওষুধ মগজে পৌঁছে। অতএব, ইনজেকশন সম্পর্কে ইমদাদুল ফতওয়ার বক্তব্য ভুল, কাজেই তা গ্রহণযোগ্য নয়।
যত প্রকারের ইনজেকশন হোক না কেন, তা এক সময় রক্ত স্রোতে মিশবে এবং মগজে পৌঁছে যাবে। সুতরাং রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কারণ, ফিক্বাহের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে,
“যা নাক, কান, পায়খানার রাস্তা ইত্যাদি দ্বারা মগজ অথবা পেটে পৌঁছবে, তাতে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (বাদায়ে)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে আরো উল্লেখ করা হয় যে,
“কান, নাক ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ ইত্যাদি মগজ অথবা পেটে পৌঁছা সকলের নিকটেই রোজা ভঙ্গের কারণ।(খোলাসাতুল ফতওয়া)
অনুরূপ হেদায়া, আইনুল হেদায়া, মাবসূত, বাহ্রুর রায়েক, রদ্দুল মোহতারে উল্লেখ আছে।
উপরোক্ত কিতাবসমূহে যদিও ওষুধ ইত্যাদি মূল রাস্তা অর্থাৎ নাক, কান, মুখ ইত্যাদি দিয়ে মগজ অথবা পেটে পৌঁছার কথা বলা হয়েছে কিন্তু ইমামগণের নিকট মূল রাস্তা শর্ত নয়, যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয় যে,
“হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, রোজা ভঙ্গের কারণ হলো- রোজা ভঙ্গকারী কোন কিছু ভিতরে প্রবেশ করা, সুতরাং পৌঁছাটাই গ্রহণযোগ্য, মূল রাস্তা নয়।” (মাবসূত)
আর ফতহুল ক্বাদীর ২য় জিঃ ২৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে যে,
“হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট পৌঁছাটাই গ্রহণযোগ্য।”
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
“হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে মরফূ হিসাবে বর্ণিত- নিশ্চয় রোজা ভঙ্গ হবে শরীরের ভিতর কিছু প্রবেশ করলে, বের হলে নয়।”
হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে- ওযূর ব্যাপারে নিয়ম হলো- শরীর হতে কিছু বের হলে ওযূ ভঙ্গ হবে, প্রবেশ করলে ভঙ্গ হবেনা। আর রোজার ব্যাপারে নিয়ম হলো- শরীরের ভিতর কিছু প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হবে, বের হলে নয়।
আর তিবরানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইবনে আবী শায়বা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেন, কিছু ভিতরে প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে, বের হলে রোজা ভঙ্গ হবেনা।
উপরোক্ত হাদীছ শরীফের দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, শরীরের ভিতর কোন কিছু প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। উক্ত হাদীছ শরীফে মূল রাস্তাকে শর্ত করা হয়নি। তবে সর্বক্ষেত্রেই ভিতরে কিছু প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হয় এবং বের হলে রোজা ভঙ্গ হবেনা তা নয়- যেমন সাপে কাটলে রোজা ভঙ্গ হয়না। অথচ সাপের বিষ ভিতরে প্রবেশ করে থাকে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বমী করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায় অথচ ওটা বের হয়ে থাকে। অনুরূপ শরীর হতে রক্ত বের হলে বা বের করা হলেও রোজা ভঙ্গ হওয়না।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে যে,
“তিনটি জিনিস রোজা ভঙ্গ করেনা- (১) শিঙ্গা লাগানো (অর্থাৎ শিঙ্গা দ্বারা শরীর হতে যদি ইচ্ছাকৃতভাবেও রক্ত বের করে তবেও রোজা ভঙ্গ হবেনা এখন তা যেভাবেই বের করা হোক না কেন)। (২) অনিচ্ছাকৃত বমি (৩) স্বপ্নদোষ।”
অনেকে সাপে কাটার সাথে ইনজেকশনকে তুলনা করে বলে থাকে- সাপে কাটলে যেমন বিষ ভিতরে প্রবেশ করা সত্বেও রোজা ভঙ্গ হয়না, তদ্রুপ ইনজেকশনেও রোজা ভাঙ্গবে না। মূলতঃ ইনজেকশনের দ্বারা যে ওষুধ শরীরে প্রবেশ করানো হয়, তার সাথে সাপের বিষকে কখনো মিলানো যাবেনা, কেননা এ বিষ প্রবেশের ঘটনাটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। এ ব্যাপারে আরো বলা যেতে পারে, যেমন- রোজা রেখে আগরবাতী জ্বালালে, ধুমপান করলে, কোন গ্যাস নাক দিয়ে গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। কেননা এক্ষেত্রে সবগুলো কাজ ইচ্ছা শক্তির নিয়ন্ত্রনে। অথচ আমরা রাস্তায় চলা-ফেরার ও রান্না-বান্নার সময় যে ধোঁয়া গ্রহণ করি, তাতে রোজা ভঙ্গ হয়না। কেননা এটা আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে। অতএব, ইনজেকশনের সাথে সাপের বিষের সাথে কিয়াস করা সম্পূর্ণই ভুল। কারণ ইনজেকশন ইচ্ছাকৃতভাবেই দেওয়া হয়।
অনুরূপ যদি কেউ ভুলে পেট ভরেও খাদ্য খায়, তবে তার রোজা ভঙ্গ হবেনা। কেননা হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় খেল অথবা পান করলো, সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে নেয়। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনিই তাকে খাদ্য খাইয়েছেন ও পান করায়েছেন।”
আর অখাদ্য যেমন পাথর, কাঠের টুকরা ইত্যাদি ইচ্ছাকৃতভাবে খেলেও রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তদ্রুপ ওযূর পানি অনিচ্ছাকৃতভাবে মুখের ভিতর চলে গেলেও রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এরূপ অবস্থায় রোজা কাজ্বা করতে হবে।
মূলকথা হলো, মূল রাস্তা শর্ত নয় বরং শরীরের যেকোন স্থান দিয়েই ওষুধ ইত্যাদি প্রবেশ করুক না কেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, তা মগজে অথবা পেটে পৌঁছেছে, তবে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। অতএব ইনজেকশনের দ্বারা যে ওষুধ শরীরে প্রবেশ করানো হয়, তা যে মগজে পৌঁছে তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। এটাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিমত। সুতরাং ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
এখানে একটি বিষয় খুবই লক্ষনীয়, তাহলো- কারো যদি রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় ইনজেকশন নেওয়ার খুব বেশী প্রয়োজন হয়ে যায়, তবে তার জন্যে রোজা না রাখার হুকুম তো শরীয়তে রয়েই গেছে। যেমন আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
“আর যদি কেউ অসুস্থ বা মুসাফির হয়, তবে অন্য সময় রোজাগুলো আদায় করবে।”
এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, অসুস্থতার কারণে, মুসাফির সফরের কারণে অথবা কারো রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নেওয়ার প্রয়োজন হলো, অনুরূপ শরয়ী কোন ওজরের কারণে যদি কেউ রমজান মাসে রোজা না রাখে এবং অন্য সময় রোজাগুলো আদায় করে নেয়, তবে কি সে রমজান মাসের ন্যায় ফযীলত লাভ করতে পারবে?
তার জবাবে বলতে হয়- হ্যাঁ কেউ যদি অসুস্থতার কারণে, সফর অথবা শরয়ী যেকোন ওজরের কারণে রমজান মাসে রোজা রাখতে না পারে এবং অন্য সময় রোজাগুলো আদায় করে নেয়, তবে সে রমজান মাসের ন্যায় সকল ফাযায়েল-ফযীলত হাছিল করতে পারবে। কারণ শরীয়তের কোথাও উল্লেখ নেই যে, এরূপ ব্যক্তি রমযানের ফাযায়েল-ফযীলত হাসিল করতে পারবেনা। বরং হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ওজর অথবা রোগ ব্যতীত রমজান মাসের একটি রোজা ভঙ্গ করবে, সে যদি তার পরিবর্তে সারা বছরও রোজা রাখে, তবেও ওটার সমকক্ষ হবেনা।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ)
এ প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে যে, যেমন- মেয়েদের অসুস্থতার (অর্থাৎ হায়েজ-নেফাস)-এর সময় নামায পড়া ও রোজা রাখা নিষেধ। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর রোজা কাজ্বা করতে হয় কিন্তু নামায কাজ্বা করতে হয়না। এর কি কারণ?
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয় যে,
“হযরত মুয়াজাহ্ আদভিয়া তাবেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, হায়েজগ্রস্থা স্ত্রীলোক রোজা কাজ্বা করে কিন্তু নামায কাজ্বা করেনা, তার কি কারণ? তখন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি বলেন, যখন আমরা এ অবস্থায় পৌঁছাতাম, তখন আমাদেরকে রোজার কাজ্বা করার আদেশ দেওয়া হতো কিন্তু নামায কাজ্বা করার আদেশ দেয়া হতোনা।” (অথচ আমরা কখনো কোন কারণ তালাশ করিনি) (মুসলিম শরীফ)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যে সকল মেয়েরা অসুস্থতার কারণে নামায পড়তে পারেনা এবং রমযান মাসে কিছু সংখ্যক রোজা রাখতে পারলোনা, তবে কি তারা উক্ত নামাজের ফযীলত ও রমজান মাসের রোজার ফযীলত হতে মাহরূম থাকবে? জবাবে বলা যায়- কখনোই নয় বরং সে নামায ও রোজার পরিপূর্ণ ফযীলতই লাভ করবে। কারণ সে শরীয়তের দৃষ্টিতে মাজূর।
অনুরূপ কারো যদি ওযু অথবা গোসলের প্রয়োজন হয় কিন্তু যদি পানি পাওয়া না যায়, তবে তায়াম্মুম করে নামায আদায় করবে, এখানে পানি দ্বারা ওযু-গোসল করে নামায আদায় করলে যে ফযীলত সে লাভ করতো, তায়াম্মুমের দ্বারা নামায পড়লেও সে ততটুকু ফযীলত লাভ করবে।
এমনিভাবে ই’তিকাফকারী সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে,
ই’তিকাফকারী সম্পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “সে ব্যক্তি মূলতঃ সকল গুণাহ্ হতে বিরত এবং সকল নেক আমলের ফযীলত তাকেও দান করা হয়।”
অর্থাৎ ই’তিকাফকারী মসজিদে আবদ্ধ থাকার কারণে বাইরের যে নেক কাজগুলো করতে পারেন না, সে সকল নেক কাজের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়ে থাকে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, যারা ওজরবশতঃ বা অসুস্থতার কারণে রমযান মাসের রোজা রাখতে পারবেনা, তারা অন্য সময় উক্ত রোজাগুলো আদায় করলে অবশ্যই রমযান মাসের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ ফাযায়েল-ফযীলত লাভ করতে পারবে। বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখিত অবস্থায় রোজা রাখার মধ্যেই বরং কোন ফায়দা বা ছওয়াব নেই। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন- একবার রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সফরে ছিলেন, একস্থানে লোকের ভীড় দেখলেন, (সেখানে গিয়ে দেখলেন) এক ব্যক্তির উপরে ছায়া দেওয়া হচ্ছে। (এটা দেখে) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে কি?” লোকেরা বললো- (যাকে ছায়া দেওয়া হচ্ছে) সে একজন রোজাদার, (তখন) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “সফরে রোজা রাখা সাওয়াবের কাজ নয়।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
অতএব, কেউ যদি ওজরবশতঃ রমজান মাসে কিছু রোজা রাখতে না পারে, তবে সে তা অন্য সময় ক্বাজা আদায় করলেও রমজান মাসের ন্যায় ফযীলত লাভ করবে।
মূলতঃ রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেন বান্দা “তাক্ওয়া” বা পরহেযগারী হাছিল করতে পারে। আর তাই বলা হয়েছে, لعلكم تتقون অর্থাৎ রমজান মাসের রোজার মাধ্যমে তোমরা “তাকওয়া” বা খোদাভীতি হাছিল করতে পারবে। কারণ رمضان (রমাদ্বন) শব্দটির উৎপত্তিই হচ্ছে- রমাদ্ব হতে, যার অর্থ হচ্ছে- জ্বালিয়ে দেওয়া, নিঃচিহ্ন করে দেওয়া। অতএব, বুঝা গেল যে, রমজান এমন একখানা মাস, যে মাস রোজাদার বান্দার সকল অন্যায়, অপরাধ, গুণাহ্খাতা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সম্পূর্ণ নিঃচিহ্ন করে দেয়।
তাছাড়া الصوم (ছাওম) শব্দের অর্থই হচ্ছে- الامساك (আল্ ইমসাক) অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের পক্ষ হতে নিষেধকৃত সকল হারাম, নাজায়িয এমন কি মাকরূহ্ কাজ হতেও রোজা অবস্থায় নিজেকে ফিরায়ে রাখা বা বিরত রাখা। আর এজন্যেই হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, الصوم جنة অর্থাৎ রোজা হলো- “ঢাল স্বরূপ।”
ঢাল যেরূপ মানুষকে নানা প্রকার বিপদাপদ হতে বাঁচায়ে রাখে, রোজাও তদ্রুপ ঈমানদার বান্দাকে সকল প্রকার হারাম, নাজায়িয, মাকরূহ্ এমনকি “তাকওয়া” খিলাফ অর্থাৎ সন্দেহজনক কাজ বা আমল হতেও হিফাযত করে বা বাঁচিয়ে রাখে। আর বান্দাকে করে দেয় মাছূম বা নিষ্পাপ। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে,
“যদি কেউ রমযান মাসের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সবগুলো রোজা (ছহীহভাবে) আদায় করে, তবে সে গুণাহ্ হতে এরূপ পবিত্র হবে, যেন সে আজকেই জন্মগ্রহণ করেছে।”
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, রোজাদার বান্দা হারাম, নাজায়িয ও মাকরূহ্ কাজ তো করতে পারবেই না বরং তাকে তাকওয়ার খিলাফ কাজ হতেও বেঁচে থাকতে হবে। তবেই তার পক্ষে তাকওয়া হাছিল করা বা মুত্তাক্বী হওয়া সম্ভব। আর যে ব্যক্তি মুত্তাক্বী হতে পারবে, তার জন্যেই কামিয়াবী। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি কালামে পাকে ইরশাদ করেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আমার নিকট অধিক সম্মানিত, যে ব্যক্তি অধিক তাকওয়াধারী বা মুত্তাক্বী।”
আর হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
“যে ব্যক্তি সন্দেহ হতে বাঁচলো (অর্থাৎ তাক্ওয়া হাছিল করলো), সে তার দ্বীন ও সম্মানকে হিফাযত করলো।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
অতএব, রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিয়ে একটি বুনিয়াদী ফরজ তরক করে মুত্তাক্বী হওয়াতো দূরের কথা, বরং ফরজ তরক করার কারণে কবীরা গুণাহে গুণাহগার হবে।
এখন কেউ বলতে পারেন, আমরা যারা জেনে বা না জেনে রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিয়েছি, আমাদের এ রোজার ব্যাপারে ফায়সালা কি? এবং তা কাজ্বা করতে হবে কি?
হ্যাঁ, জেনে হোক অথবা না জেনে হোক রোজা অবস্থায় যারা ইনজেকশন নিয়েছে, তাদের উক্ত রোজা অবশ্যই কাজ্বা করতে হবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবেনা।
উপরোক্ত কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ ও ফিক্বাহের অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সারগর্ভ আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়।