Topic: বেশি চিনি বেশি ক্ষতি! - ডা. এ আর এম সাইফুদ্দীন একরাম

বেশি কিছুই ভালো নয়। জেনে না জেনে প্রতিদিনই আমরা খাদ্যে নানাভাবে চিনি গ্রহণ করছি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শরীরে। আলোচনা করেছেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ডা. এ আর এম সাইফুদ্দীন একরাম

জনপ্রিয় একটি কনডেন্সড মিল্কের বিজ্ঞাপনে একসময় বলা হতো, 'বাড়তি চিনি কী দরকার?' অর্থাৎ ওই দুধে যে পরিমাণ চিনি আছে তাতে আর বাড়তি চিনি দেওয়ার দরকার নেই। ক্রেতা হয়তো ভাবতো, আরে এখানেই তো লাভ! বাস্তবে কিন্তু বিস্তর ক্ষতি।
দৈনন্দিন খাবার ও পানীয়ের অনেকগুলোতেই অতিরিক্ত চিনি কিংবা বাড়তি কৃত্রিম শর্করা যোগ করা থাকে। নিয়মিত এসব বাড়তি চিনিযুক্ত খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করায় স্থূলতাসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে। তাই বলে কি এসব শর্করা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে? বাদ দিতে হবে খাদ্য তালিকা থেকে? নিশ্চয়ই নয়। কারণ শরীরের জন্যই শর্করা দরকার। কিন্তু তার মাত্রা যাতে বেশি না হয় খেয়াল রাখতে হবে সেটাই।
স্বাস্থ্যকর অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যেই কিছু না কিছু শর্করা থাকে। কারণ সুষম খাদ্যের অন্যতম উপাদান এই শর্করা। সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড এবং পানীয়তে থাকা বাড়তি চিনি এবং শর্করা। এটা শুধু খাবারে ক্যালরির মাত্রা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। তা ছাড়া ফাস্টফুড এবং নানা রকম পানীয়, ক্যান্ডি, চুইংগাম, চকোলেট, জ্যাম, জেলি এসব বাড়তি চিনিযুক্ত খাবারে প্রকৃত পুষ্টিগুণ সামান্যই থাকে। তাই বলা যায় জনস্বাস্থ্যের জন্য এসব খাবার এক ধরনের হুমকি।
মনে প্রশ্ন আসতে পারে, শর্করা কি শরীরে কোনো কাজে লাগে?
প্রাকৃতিক কিংবা প্রক্রিয়াজাত সব শর্করাই শরীরে শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক খাবার যেমন চাল, গম, ভুট্টা, ফলমূল, সবজি, দুধ ইত্যাদির শর্করা দেহে শক্তির প্রধান উৎস।
কিন্তু প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন ফাস্টফুড এবং পানীয়ের সঙ্গে বাড়তি চিনি যোগ করা হয় কেন?
বেশ কয়েকটি কারণে তা করা হয়_
ফাস্টফুড ও পানীয়কে সুস্বাদু করে।
* বেকারির খাবারে বিশেষ রং ও গঠন দেয়।
* জ্যাম, জেলি প্রভৃতি সংরক্ষণে সাহায্য করে।
* গাজন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে, ফলে রুটি জাতীয় খাবার ফুলে ওঠে।
* ভিনেগার ও টমেটো সমৃদ্ধ খাবারের অম্লত্ব প্রশমন করে।
অতিরিক্ত চিনি যোগ করায় বাড়তি কিছু উপকারিতা আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর সঙ্গে প্রক্রিয়াকরণের সুবিধার্থে কিছু চর্বিও যোগ করা হয়। চর্বি এবং বাড়তি চিনিকে একসঙ্গে সোফাস বলে। কোনো কোনো খাবারের মোট ক্যালরির এক-তৃতীয়াংশ আসছে সোফাস থেকে। যখন কারো দৈনিক ক্যালরি চাহিদার এত বেশি অংশ চর্বি এবং চিনি থেকে আসে, তখন বুঝতে হবে ওই খাবার কোনোভাবেই স্বাস্থ্যপ্রদ নয়।
বেশি চিনি যেসব স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে_
* বেশি চিনি মানেই অতিরিক্ত ক্যালরি। এসব খেয়ে পরিমাণের তুলনায় বাড়তি ক্যালরি গ্রহণ করা হয়। ফলে ওজন বাড়ে।
* চিনি দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে লেগে থেকে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়। ফলে দাঁত ক্ষয় হয়। বিশেষত চকোলেট, ক্যান্ডি, চুইংগাম, কেক-পেস্ট্রি জাতীয় খাবার ঘন ঘন গ্রহণ করলে এ ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। এ জন্য দেখা যায় বহু শিশু-কিশোরের দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো নয়।
* ফাস্টফুড ক্যালরি চাহিদা পূরণ করে, কিন্তু অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ উপাদান ইত্যাদির আনুপাতিক ঘাটতি খাদ্যে রয়েই যায়। ফলে শরীর অপুষ্টি বা অপপুষ্টির শিকার হয়।
* বাড়তি চিনি রক্তে ট্রাইগি্লসারাইডের
পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তনালিতে জমে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকসহ বহু রোগের কারণ হয়ে
দাঁড়ায়।
তাহলে দৈনিক খাবারে কতটুকু চিনি নিরাপদ?
এর কোনো সঠিক পরিমাণ নির্দেশ করা যায় না। তবে বলা যায়, খাবারে চিনি যতটা সম্ভব কমানোটাই ভালো। সার্বিকভাবে যে কারো দিনে পাঁচ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি ক্যালরি সোফাস থেকে আসা উচিত নয়।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, কোনো মহিলার দৈনিক খাদ্য তালিকায় ১০০ ক্যালরি, আর পুরুষের জন্য এটা ১৫০ ক্যালরির বেশি হওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ সারা দিনের খাবারের তালিকায় ছয় চা চামচ (মহিলাদের জন্য) থেকে নয় চা চামচ (পুরুষদের জন্য) বেশি বাড়তি চিনি থাকা উচিত নয়। অধিকাংশ পশ্চিমা নাগরিক দিনে ২২ চা চামচ অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করে থাকে। দেশেও এর হার খুব একটা নগণ্য নয়। এখানে সরাসরি চিনি গ্রহণের কথা কিন্তু বলা হচ্ছে না। আলাদাভাবে চিনি ও খাদ্যদ্রব্যে থাকা মোট চিনির পরিমাণকে বোঝানো হচ্ছে।
তাহলে কিভাবে খাবারে চিনির প্রভাব কমাবেন? নিচের উপায়গুলো বিবেচনা করতে পারেন।
* সরাসরি চিনিযুক্ত খাদ্য (মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি) যতটা সম্ভব বাদ দিন।
* ক্যান্ডি, চুইংগাম, চকোলেট, আইসক্রিম, কেক পেস্ট্রি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
* কেক, কুকি এবং অন্যান্য মিষ্টি স্ন্যাকসের পরিবর্তে তাজা ফলমূল খান।
* মিষ্টি ফলের পরিবর্তে কম মিষ্টি কিংবা টক ফলকে প্রাধান্য দিন।
* মিষ্টি সিরাপে সংরক্ষিত কৌটাজাত খাদ্য এড়িয়ে চলুন।
* ফলের রস এবং কোমল পানীয়ের পরিবর্তে দুধ, ডাবের পানি কিংবা সাধারণ পানি পান করুন।
* চা-কফিতে চিনি ব্যবহার না করাই ভালো কিংবা কম করতে পারেন।
অনেক সময় বাজারে কোন খাদ্যে চিনি আছে তা বোঝা যায় না। খাবারে চিনির পরিমাণ জানার জন্য মোড়কের গায়ে লেখা উপাদানের তালিকা দেখতে পারেন। নিজের সাধারণ জ্ঞানও কাজে লাগাতে পারেন।
নিচের খাবারগুলোর ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে পারেন।
* বাদামি চিনি বা ব্রাউন সুগার_মোলাসেসযুক্ত দানাদার সাদা চিনি বেকিংয়ের জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়।
* আখের রস এবং আখের সিরাপ_এটাকে পরিশোধন করলেই সাদা চিনি পাওয়া যায়।
* ডেঙ্ট্রোজ_গ্লুকোজের আরেক নাম।
* ফ্রুক্টোজ_ফল, মধু এবং সবজি থেকে পাওয়া চিনি, যা শরীরে গিয়ে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হতে পারে।
* মধু_এতে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং সুক্রোজের মিশ্রণ যুক্ত চিনি থাকে।
* ম্যাল্টোজ_বিয়ার, রুটি এবং শিশু খাদ্যে ব্যবহৃত চিনি।
* মল্ট সিরাপ_শস্যবাটা এবং সদ্য অঙ্কুরিত বার্লি থেকে প্রস্তুত করা মিষ্টি রস।
* মোলাসেস_আরেক নাম চিটাগুড়।
এবার নিজেই হিসাব করুন সারা দিনে যে খাবার খাচ্ছেন তাতে কতটা বাড়তি চিনি শরীরে ঢুকছে! যদি মনে হয়, চিনির পরিমাণ বেশি হচ্ছে, আজই কমানো শুরু করুন।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ