Topic: ইফতারিতে ভেজাল : চেনার উপায়
এ এইচ এম আনোয়ার পাশা
একটু সচেতন হলে কিছু ভেজাল ও ক্ষতিকর খাদ্য আমরা সহজেই চিনে নিয়ে এগুলো পরিহার করতে পারি। একসময় সবুজ রঙের সন্দেশ বা বাহারি রঙের কেক-পেস্ট্রি পাওয়া যেত। রঙিন খাবার পরিহারে সাধারণ মানুষের মধ্যে আমরা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। মানুষ এগুলো কেনে না বলে সবুজ সন্দেশ আর তৈরি হয় না। খাবার সাদা বা পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর হাইড্রোজ। যেসব খাদ্যে হাইড্রোজ ব্যবহার হয় সেগুলো যদি আমরা চিনে নিয়ে পরিহার শুরু করি তাহলে এর ব্যবহারও কমে যাবে। ক্ষতিকর হাইড্রোজ আসলে কী? হাইড্রোজের রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। গার্মেন্ট শিল্পে কাপড়ের রং সাদা করতে এটি ব্যবহৃত হয়। অথচ খাদ্য সাদা বা পরিষ্কার করতে এটি খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে খাদ্য হচ্ছে বিষাক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কার্সিনোজেনিক, যা ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এ ছাড়া পাকস্থলী, লিভার ও কিডনির জটিল রোগ সৃষ্টি করে। হাইড্রোজযুক্ত সাদা বা পরিষ্কার খাবার চিনে নিয়ে এগুলো পরিহার করলে এসব অসুখ-বিসুখ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারি।
সাদা মুড়ি : দুইবার সিদ্ধ করায় মুড়ির চাল লালচে হয়ে থাকে। এ চাল থেকে লালচে মুড়ি হবে_এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাজারে লালচে মুড়ির চাহিদা কম বলে মুড়ি সাদা করতে কারখানার মালিক মুড়িতে হাইড্রোজ অথবা ইউরিয়া সার ব্যবহার করে। তাহলে স্বাভাবিক লালচে মুড়ি না খেয়ে আমরা কেন কেমিক্যালযুক্ত সাদা মুড়ি খাব? যাত্রাবাড়ীর একটি মুড়ি কারখানার মালিক স্বীকার করেন, তিনি বর্তমানে বাধ্য হয়ে মুড়িতে হাইড্রোজ দিচ্ছেন। গত বছর হাইড্রোজ না দেওয়ায় লাল মুড়ির ক্রেতা পাওয়া যায়নি। রমজানের পরও লাল মুড়ি অবিক্রীত পড়ে ছিল। কিন্তু অন্য কারখানাগুলোর সাদা মুড়ি প্রচুর বিক্রি হয়েছে। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তিনি রমজানের আগে থেকেই হাইড্রোজ ব্যবহার শুরু করেন। এ অপরাধে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা স্বাভাবিক লালচে মুড়ি খাওয়া শুরু করলে লাল মুড়ির চাহিদা বেড়ে যাবে। ফলে অসাধু মুড়ি কারখানাগুলো ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার বন্ধ করবে।
সাদা গুড় : পরিষ্কার সাদা আখের গুড় ভোক্তাকে আকৃষ্ট করলেও এটি আখের গুড়ের স্বাভাবিক রং নয়। গুড়ে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার না করলে এর রং হয় লালচে এবং খানিকটা কালচে। আখক্ষেতে আখ মাড়াই করে লম্বা কড়াইভরে রস জ্বাল করে সারা রাত গুড় তৈরি করা হয়। চুলার পাশে সাদা কেমিক্যালের পুঁটলি থাকা স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। যারা গুড়ে এগুলো মেশায় তারা হাইড্রোজের ক্ষতি বোঝে না, শুধু জানে এটা না দিলে তার গুড় বাজারে চলবে না। সাভারের নামাবাজারে একটি গুড় কারখানায় হাইড্রোজ দিয়ে চিটাগুড় সাদা করে চিনির সঙ্গে মিশিয়ে সাদা আখের গুড় তৈরি করার সময় হাতেনাতে ধরা হয় একজনকে।
সারা দিন রোজা রেখে হাইড্রোজযুক্ত ক্ষতিকর গুড়ের শরবত দিয়ে কেন আমরা ইফতার শুরু করব? আমরা কেন এই সাদা গুড় কিনব?
সাদা জিলাপি : ঢাকার তিলপাপাড়া ত্রিমোহনী মোড়ে সাত-আটটি মিষ্টির দোকান। এখানে যারা মিষ্টি বানায় তাদের ধারণা, হাইড্রোজ ছাড়া জিলাপি হয় না। জিলাপির খামির জমতে একটু সময় নেবে। কিন্তু যারা অল্প সময়ে জিলাপি বানায় তারা হাইড্রোজ দেয়। এতে জিলাপি হয় মচমচে এবং সাদা। জিলাপির স্বাভাবিক রং হচ্ছে ঈষৎ লালচে। সাদা জিলাপি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
তালমিছরি : তালমিছরি নামে সাদা ধবধবে স্ফটিকের মতো যা বাজারে পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই চিনির তৈরি। এ ধরনের বেশ কয়েকটি কারখানায় অভিযানে দেখা যায়, চিনি জ্বাল করে হাইড্রোজ মিশিয়ে তালমিছরি তৈরি করা হচ্ছে। যারা তৈরি করছে তাদের বক্তব্য, সারা দেশে যত মিছরি পাওয়া যায় তার সব হাইড্রোজ দিয়ে তৈরি। অথচ পানিতে তালমিছরি ভিজিয়ে রেখে সে পানির শরবত দিয়ে অনেকে ইফতার করেন। মেলার মাঠে হাতি-ঘোড়ার ছাঁচে তৈরি মিছরি, কদমা খুব জনপ্রিয় হলেও এগুলো তৈরি হয় হাইড্রোজ দিয়ে। মাতুয়াইলের একটি বড় মিছরি কারখানায় এক ড্রাম হাইড্রোজ পাওয়া যায়। মিছরি তৈরিতে হাইড্রোজ ব্যবহারের কারণে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এই খাদ্য পরিহার করাই নিরাপদ।
মিষ্টি : সাভারের নামাবাজারের মিষ্টির কারখানায় অভিযান চালিয়ে ৮-৯টি কারখানায় হাইড্রোজ পাওয়া যায়। কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিষ্টি গোল্লা যখন তৈরি করা হয় তখন ছানার সঙ্গে হাইড্রোজ দিলে ভাজার সময় ফেটে যায়। তাই সাদা মিষ্টি তৈরি করতে তারা চিনির শিরায় হাইড্রোজ দেয়। সাদা মিষ্টির গোল্লা তেলে ভেজে হাইড্রোজ মেশানো চিনির শিরায় ছেড়ে দিলে ধবধবে সাদা রসগোল্লা তৈরি হয়। এ ধরনের অস্বাভাবিক সাদা রসগোল্লা কেনা উচিত নয়।
ছোলা : কালচে ছোলার পুষ্টিমান কম না হলেও লোকে কম কেনে বলে এর দাম তুলনামূলক বেশ কম। ইফতার বিক্রেতারা খরচ কমাতে এ ছোলাই ব্যবহার করে। অনেকে ছোলা সিদ্ধ করে হাইড্রোজ দিয়ে সাদা করে। তাই বাজারে তৈরি সাদা ছোলার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে কালো ছোলা খেলে ক্ষতি নেই। এ ছাড়া হাইড্রোজের ব্যবহার দেখা যায় বেকারিতে সাদা বিস্কুট তৈরির কাজে। হাইড্রোজ না দিলে ময়দার তৈরি বিস্কুট সাদা হয় না। অতিরিক্ত সাদা বিসু্কট না খাওয়াই ভালো। খাবারে হাইড্রোজের উপস্থিতি তাৎক্ষণিক শনাক্তকরণের কোনো কিট না থাকলেও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এ নিয়ে কাজ করছে।
এ তো গেল হাইড্রোজের ব্যবহার। এবার বলছি রঙিন খাবারের বিষয়ে। এরই মধ্যে রঙিন খাবার পরিহারে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইফতারসামগ্রীতে এখনো এর প্রয়োগ উদ্বেগজনক। ফুড গ্রেড কালার ক্ষতিকর নয় বলে অনেকের ধারণা। ভালো মানের খাবারের রং অত্যন্ত ব্যয়বহুল (প্রতি কেজি চার হাজার ৫০০ টাকা) বলে অসাধু ব্যক্তিরা নিম্নমানের রং বা কাপড়ের রং (প্রতি কেজি ২০০ টাকা) দিয়ে খাবার রং করে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এ ছাড়া নিম্নমানের রঙের গায়ে ফুড কালারের লেবেল লাগানোর নজির দেখা যায়। তাই খাদ্যের রঙের ব্যবহার কম হওয়াই নিরাপদ। ভালো মানের ফুড গ্রেড কালার চেনার উপায় হলো ভেজা হাতে রং লাগিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে সহজেই উঠে যায়। কিন্তু কাপড়ের রং হাতে লাগালে হাত সাবান দিয়ে ধুলেও তা উঠতে চায় না। এসব রং কার্সিনোজেনিক, যা ক্যান্সার সৃষ্টিতে সহায়তা করে। খাদ্য পরিপাকসংশ্লিষ্ট শরীরের সব অঙ্গ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই রঙিন ইফতারি পরিহারে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি অত্যাবশ্যক।
রঙিন শরবত : ইফতার কিংবা মেহমান আপ্যায়নে হলুদ বা লাল শরবত ইদানীং রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেটে শরবত পাউডার পাওয়া যায়, যা পানিতে মিশিয়ে নিমেষে তৈরি হয়ে যায় কমলা বা আমের শরবত। যাত্রাবাড়ীর বাগানবাড়ীতে অভিযানে দেখা গেল, টিনের ছাপরার ভেতরে অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে এ ধরনের শরবতের পাউডার। বাজারে এর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ রকম কারখানা গড়ে উঠছে। এটি তৈরি হয় চিনি গুঁড়া করে তাতে ঘনচিনি ও রং মিশিয়ে। এতে কমলার কৃত্রিম ফ্লেভার দিলে হয়ে যায় কমলার শরবত আর আমের ফ্লেভার দিলে হয়ে যায় আমের শরবত। তাহলে বাড়তি টাকা খরচ করে আমরা চিনির সঙ্গে পাচ্ছি রং, ঘনচিনি আর ফ্লেভার। প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে বাড়তি চিনির প্রয়োজন নেই। অধিক পরিমাণ পানিতে অল্প পাউডার দিয়ে মিষ্টি শরবত তৈরি হওয়ার কারণ এতে রয়েছে ঘনচিনি বা কৃত্রিম মিষ্টি, যা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ। আবহমানকাল ধরে আমরা যে প্রাকৃতিক লেবুর শরবত পান করি তাই শ্রেষ্ঠ পানীয়। আধুনিক যুগেও পুরনো ঐতিহ্যটি ধরে রাখতে পারলে আমরা নিঃসন্দেহে লাভবান হব।
পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, চিকেন ফ্রাই, ছোলা ভাজলে বহিরাবরণ লালচে হতে পারে; কিন্তু এটি ভাঙলে এর ভেতরটা লাল থাকলে বুঝতে হবে এতে রং মেশানো হয়েছে। ছোলা, বেগুনি, চপ, চিকেন ফ্রাই_এগুলোকে আকর্ষণীয় করতে লাল রং মেশানো হয়। একটু সতর্ক হলে এগুলো সহজেই ধরা যায়।
রঙিন লাচ্ছা সেমাই : ঈদের দিন জামাই আপ্যায়নে এখনো গ্রামাঞ্চলে কড়া হলুদ, লাল, এমনকি সবুজ রঙের লাচ্ছা সেমাই খাওয়ানোর নজির দেখা যায়। শহরাঞ্চলে সচেতন মানুষ রঙিন সেমাই বয়কট করায় উৎপাদিত রঙিন খোলা সেমাই গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। লাচ্ছা সেমাইয়ের স্বাভাবিক রং ক্রিম কালারের এবং এর প্যাকেটের গায়ে অবশ্যই বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন বা লোগো থাকবে। ২০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট পরিমাপে প্রায়ই ১৬০ থেকে ১৭০ গ্রাম পরিমাণ পাওয়া যায়। অনুমোদিত কারখানার সেমাইয়ের ওজন সঠিক থাকে।
বুন্দিয়া, লাড্ডু ও জিলাপি : কড়া হলুদ বা লাল রঙের বুন্দিয়া এখনো ইফতারি বিক্রির দোকানে দেখা যায়। ব্যাপক অভিযানে ঢাকায় এর প্রকোপ কমলেও শিশুসহ এক শ্রেণীর ক্রেতা রঙিন বুন্দিয়া পছন্দ করে বলে ইফতারি বা লাড্ডু বানাতে এখনো রং ব্যবহৃত হয়। একইভাবে জিলাপিতে লাল ও হলুদ রং ব্যবহার করা হচ্ছে, যা সহজেই চেনা যায়। বেসনের তৈরি বুন্দিয়া বা লাড্ডুর স্বাভাবিক রং হালকা হলদে আর জিলাপি সামান্য লালচে। রঙিন বুন্দিয়া বা লাড্ডু যাতে আমাদের শিশুদের হাতে না যায় সেদিকে অভিভাবককে সচেতন হতে হবে।
দই : দুধ অতিরিক্ত জ্বালিয়ে ঘন করলে রং লালচে হয়। এ দুধ থেকে তৈরি দই লালচে হবে। এত ঘন দুধের দই ৩০০ টাকার কম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কিছু অসাধু দই ব্যবসায়ী ৫০ টাকা কেজি হিসেবে পাইকারি দরে বিভিন্ন দোকানে দই সরবরাহ করে। অথচ দুধ কিনতে হয় একই দামে। তাহলে কিভাবে এত কম দামে লালচে দই বাজারে সরবরাহ করে? বাড্ডা নতুন বাজারে অভিযানে দই তৈরির রহস্য বেরিয়ে আসে। বাজার থেকে নষ্ট পেঁপে এনে সিদ্ধ করে পচানো হয় এবং এর সঙ্গে নিম্নমানের গুঁড়োদুধ মিশিয়ে তাতে লাল রং যোগ করলে লালচে দই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু এ দই পুডিংয়ের মতো জমাট না বেঁধে একটু থলথলে হয়। স্বাভাবিক দই সাদা বা খুব হালকা হলুদ হবে কিন্তু লালচে রঙের দই দেখলে বুঝতে হবে এতে রং মেশানো হয়েছে।
মাঠা : পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারসামগ্রীর অবিচ্ছেদ্য অংশ মাঠা। ব্যাপক চাহিদার কারণে বেশ কয়েকটি মাঠা বোতলজাতকারী কারখানা গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে এগুলো বোতলজাত করা হয়। রাজধানীর জুরাইনে সাত-আটটি কারখানায় অভিযানে দেখা যায়, দুধ, চিনি ও লবণের পাশাপাশি লাল রং ব্যবহার করা হয়। উৎপাদনকারীরা জানায়, রং না দিলে মাঠা চলে না। মাঠার স্বাভাবিক রং সাদা। তাহলে সাধারণ মানুষ রঙিন মাঠা ছাড়া খেতে চায় না কেন?
মসলা : শ্যামবাজারের মসলাপট্টিতে ৮-৯টি মিলে ছোট কাউন দানা গুঁড়া করে তৈরি হতো হলুদ-মরিচ আর ধনের গুঁড়া। এটি এক ধরনের কাউন দানা, যা মানুষ খায় না, পাখি খায়, মূল্য প্রতি কেজি মাত্র ১০ টাকা। মধ্যরাতে এ ধরনের কাউন ভাঙানো হয়। এ সময় প্যাকেট থেকে অল্প অল্প করে রং ঢালা হয়। হলুদ রং দিলে হলুদের গুঁড়া, লাল রং দিলে মরিচের গুঁড়া হয়ে যায়। আসল হলুদ বা মরিচ সামান্য মিশিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। তাই খোলা মসলা কেনা খুবই বিপজ্জনক। দাঁড়িয়ে থেকে মসলা ভাঙানো উচিত অথবা প্যাকেট মসলা কিনলে বিএসটিআই লোগো আছে কি না দেখে কেনা উচিত।
লেখক : র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
কালেরকন্ঠ এর এই টপিক টি ভাল লাগল তাই সবার সাথে শেয়ার করলাম।
Medical Guideline Books