Topic: পুরুষের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা - ডা. এআরএম সাইফুদ্দীন একরাম
ডা. এআরএম সাইফুদ্দীন একরাম
অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ও বিভাগীয় প্রধান
মেডিসিন বিভাগ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
সহস্রাব্দ লক্ষ্যের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে মায়েদের স্বাস্থ্য এবং শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন। এতসব প্রচেষ্টা এবং প্রচার-প্রচারণার ভিড়ে বাবাদের স্বাস্থ্য বা পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি আমরা অবহেলা করছি কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যা কি? সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Centers for disease control and prevention) পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার একটি তালিকা করেছে।
হৃদরোগ
পুরুষের প্রধান শত্রু হৃদরোগ। অতএব সব পুরুষকে হৃদরোগ প্রতিরোধ করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এজন্য-
*ধূমপান পরিহার করতে হবে। হৃৎপিণ্ডের অন্যতম প্রধান শক্র ধূমপান। অতএব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সব ধরনের ধূমপান পরিত্যাগ করতে হবে।
*স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ। শাক-সবজি, ফল-মূল, আকাড়া শস্য দানা, অতিরিক্ত আঁশযুক্ত খাদ্য ইত্যাদি বেশি খেতে হবে। কিন্তু সম্পৃক্ত চর্বি এবং লবণযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
*ক্রনিক রোগ পরিহার করতে হবে। যেমন উচ্চরক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস হলে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। *রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
*প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে।
*শরীরের ওজন সীমিত রাখতে হবে।
*মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
*মানসিক চাপ ও উদ্বেগমুক্ত হতে হবে। সব সময় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ক্যান্সার
হৃদরোগের পরে পুরুষের দ্বিতীয় প্রধান শক্র ক্যান্সার। ফুসফুস, ত্বক, প্রোস্টেট, অন্ত্র ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সারে বহু পুরুষের অকাল মৃত্যু হয়। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো বেশ কার্যকরী।
ধূমপান পরিহার। ধূমপান পরিহার করলে যেমন হৃদরোগের সম্ভাবনা কমে, তেমনি ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে। এমনকি পরোক্ষ ধূমপান থেকে দূরে থাকলেও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
*ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
*ব্যায়াম করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা ওজন কমাতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং একইভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়।
*প্রচুর শাক-সবজি এবং ফল-মূল খেতে হবে। শাক-সবজি এবং ফল-মূল ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী।
*সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষা। অতিরিক্ত সৌরালোক ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।
*মদ্যপান সীমিত করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে অন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি, যকৃত ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অতএব মদ্যপান পরিহার করলে অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়।
ক্যান্সার শনাক্তকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কিছু কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার সুপ্তাবস্থায় বা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায়। এজন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
দুর্ঘটনা
মোটর যাবনবাহন দুর্ঘটনা পুরুষদের মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। অতএব পথে-ঘাটে চলাফেলার সময় সতর্ক থাকতে হবে। যানবাহন ব্যবহারের সময় মাথায় হেলমেট পরা এবং সিটবেল্ট বাঁধা গুরুত্বপূর্ণ। মদ্যপান কিংবা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যানবাহন চালনা করা উচিত নয়।
ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি অবরোধোক ব্যাধি
ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগে অনেক পুরুষের স্বাস্থ্যহানি হয়ে থাকে। বিশেষত ক্রনিক ব্রংকাইটিস এবং পালমোনারি এমফাইসিমায় অনেক পুরুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে থাকে। এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত-
ধূমপান পরিহার করতে হবে। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রধান কারণ ধূমপান। ধূমপান পরিহার করলে এর থেকে মুক্ত থাকা সহজ হবে।
বায়ুদূষণ পরিহার করতে হবে।
শ্বাসনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। ঘন-ঘন শ্বাসনালীর সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়।
মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক
মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত অনেক ঝুঁকি উপাদান আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন- বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, জাতি ইত্যাদি। কিন্তু কতগুলো উপাদান নিয়ন্ত্রণযোগ্য। যেমন :
ক্রনিক রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ইত্যাদি পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অতএব এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা পক্ষাঘাত প্রতিরোধের জন্য জরুরি।
ধূমপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত ধূমপান পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অতএব ধূমপান পরিহার করে পক্ষাঘাতের সংখ্যা কমানো সম্ভব।
মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস বিশেষত টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে হৃদরোগ, চোখের রেটিনার সমস্যা, স্নায়ুরোগ এবং আরও অনেক জটিলতা হয়। অতএব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অধিকাংশ পুরুষ তাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারেন। এজন্য
নিয়মিত জীবনাচরণ মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে।
আত্মহত্যা
পুরুষের স্বাস্থ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আত্মহত্যাপ্রবণতা। সাধারণত বিষন্নতা থেকে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে। কারও বিষন্নতার লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে অবশ্যই তার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে বিষন্নতাদূর করার মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সবশেষে বলতে হয়, স্বাস্থ্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা সহজ; কিন্তু প্রতিরোধের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ নয়। তবে সবক্ষেত্রে পুরুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল সূত্রটি একই; আর তা হচ্ছে- স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করা, ধূমপান পরিহার করা, মদ্যপান না করা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। এর সুফল আমরা যা কল্পনা করি, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।