Topic: মুভি রিভিউ: আমার বন্ধু রাশেদ
মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেছেন 'আমার বন্ধু রাশেদ'। ছবিতে ৪ কিশোর বন্ধুকে দেখতে পাওয়া যায়। এরা হলো রাশেদ, ইবু, দিলীপ, আশরাফ ও ফজলু। হিন্দু হবার অপরাধে প্রাণ বাঁচাতে পরিবার-পরিজন বাঁচাতে দিলীপের বাবা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। যাবার আগে নিজের জমির দলিলটা মুসলমান বন্ধুর কাছেই রেখে যায়। দিলীপের বাবার বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার দৃশ্য সে সময়ে হিন্দুদের অসহায় অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওদের বিদায় নেবার দৃশ্যে দিলীপ বলে, আমাদের পরিবারের সবাইকে একটা করে মুসলমান নাম রাখা হয়েছে। আমার নাম আমি নিজেই রেখেছি, রকিবুল ইসলাম। ইবু বলে সে তো আমার নাম। দিলীপ বলে, তুই আর আমি তো একটিই কথা। দু'বন্ধু জড়িয়ে কাঁদে...যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বন্ধু বিচ্ছেদের যন্ত্রণা দর্শক হৃদয়ে বাজে বেহালার করম্নণ সুরে। দিলীপের মায়ের বোরখা পরা মুখ অচেনা ও উদ্ভট লাগে ইবুর কিশোর মনে। ইবুর মনের সঙ্গে সঙ্গে পর্দার ফ্লাশব্যাকে ভেসে ওঠে সিঁথিতে সিঁদুর আঁকা চিরকালীন হিন্দু মায়ের হাতে পূজার প্রাসাদ খাইয়ে দেবার স্মৃতি।
ইবুর বাবা-মা সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে আর প্রশ্নের উত্তর খোঁজে ঈশ্বরের কাছে কেন এমন হলো দেশটার। ছবির প্রধান চরিত্র ইবুর বন্ধু রাশেদ অনুসন্ধিৎসু চোখে জাহাজে করে পাকিসত্মানী বাহিনীর সমসত্ম কার্যক্রম দেখে আর ইবুকে জানায়। বাহ্যিকভাবে রাশেদকে যতটা নির্বিকার দেখায় ভিতরে ভিতরে ঠিক ততটাই জ্বলে উঠছিল রাশেদ। বাবা-মায়ের শানত্ম ছেলে ইবুকেও সঙ্গী করে নিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার ও আলবদরদের জঘন্য কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে। শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, এক সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীকে মিলিটারি ক্যাম্পের অবস্থান সংক্রানত্ম ম্যাপ পৌছে দেয়া, জীবনবাজি রেখে শরীরে গুলি বেঁধে মুক্তিবাহিনীকে পেঁৗছে দেয়া, পাকিসত্মানী মিলিটারির বিরম্নদ্ধে সরাসরি অপারেশনে অংশগ্রহণ করা এবং সবশেষে কমান্ডো স্টাইলে যুদ্ধাহত শফিককে হাসপাতাল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসার ধারাবাহিক দুঃসাহসিক কার্যক্রম দর্শক হৃদয়কে পস্নাবিত করে মুক্তির আনন্দে।
মুক্তিবাহিনীর ধরা পড়া শফিককে সবার সামনে বর্বোরচিতভাবে নির্যাতন করে মারা হবে_এই কথা যখন রাজাকারের সহযোগীরা মাইকে প্রচার করছিল ইবু তা শুনে বমি করে। রাজাকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধা প্রিয় শফিক ভাইয়ের অযাচিত মৃতু্য আশঙ্কা ও অপমান, লুকিয়ে লুকিয়ে নানান অপারেশনে সম্পৃক্ত হওয়া, বাবা-মার কাছে সবকিছু গোপন করা, এসব কিছু ইবুকে স্বল্প সময়ের জন্য মানসিক শারীরিকভাবে বিপর্যসত্ম করে তুলেছিল। শেষে স্নেহময়ী মায়ের আদরে শফিক ভাইয়ের খবরটা মাকে জানাতে পারায় স্বসত্মি পায় ইবু।
রাশেদ সকল পরিকল্পনার প্রধান হিসেবে কাজ করে। প্রত্যেক অপারেশনের আগে বন্ধুদের বলে, 'দেশের নামে শপথ কর, মরে গেলেও কাউকে কিছু বলবি না।' তারপর একে একে একত্রিত হওয়া মুষ্টিবদ্ধ হাত শপথের সত্যিকার শক্তিকে প্রবাহিত করে দর্শক হৃদয়ে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সাহস উজ্জীবিত করে এই প্রজন্মের তরম্নণকে। আহা আমি কি পারতাম যুদ্ধে যেতে দেশের জন্য? অথবা এখনও কি পারি যদি তেমন সঙ্কটে পড়ে দেশ?
অপরাধীরা সব সময় ভীতু। রাজাকাররা চরম সাহস দেখিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিপৰে কাজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা যে ভীতু সেই দৃশ্যটি পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম উপস্থাপন করেন রাশেদকে দিয়ে রাজাকার আজরফ আলীকে ভয় দেখানোর মধ্য দিয়ে।
দিনের শেষ আলোর নিচে রেললাইনের রেলিংয়ের ওপর বসে থাকা রাশেদ ও ইবুর ছবিটি সিনেমাটোগ্রাফার অপু রোজারিওর নৈপুণ্যকে দর্শক চোখে বিছিয়ে দেয় অদ্ভুত সৌন্দর্যের গোধূলি গালিচা। রাজাকার আজরফ আলীর ভূমিকায় অভিনয় করা গাজী রাকায়েতের জন্য দর্শকের মনে জন্ম নেয় ঘৃণা; যা তার অভিনয় দৰতার ধারাবহিক পরিচয়। প্রাসাদ খাইয়ে দেয়া, ইবু ও দিলীপের বিদায় দৃশ্য এবং পুরো ছবিতে যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি ইমন সাহার ব্যবহৃত নেপথ্য সঙ্গীতের যথার্থ ব্যবহার নিঃসন্দেহে। শফিকের ভূমিকায় অভিনয়কারী মুরাদ পারভেজ মুক্তিযোদ্ধার শক্তিতে হয়তবা অরেকটু জ্বলে উঠতে পারতেন। কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রথম দিকে দু'একটি জায়গায় কিছুটা দুর্বল মনে হলেও ছবির পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকেও জ্বলে উঠতে দেখা যায় পরিণত ভঙ্গিমায়।
Download link দিয়ে দেব পেলে।