Topic: মুখ ও ঠোটে ঘা
অনেকের মুখে প্রায়ই ঘা দেখা দেয়। তারা হয়তো ভাবেন এ আর এমনকি! আবার ভালোও হয়ে যাচ্ছে। চার-পাঁচ দিন কষ্টের পর ভালো হলে রোগটিকে আমলে আনার দরকার কি? সমস্যা হচ্ছে মুখের ঘা যেমন ভিটামিন-শূন্যতার কারণে দেখা দিতে পারে; তেমনি মুখ ও ঠোটে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণেও হতে পারে। তবে শরীরে পুষ্টির অভাবে তথা ভিটামিন-শূন্যতার কারণে অনেক সময় ভাইরাসসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সন্ধানী জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। এজন্য মুখের ভাইরাস রোগে কিছুটা হলেও বিশেষ করে ভিটামিন প্রয়োগে ফল পাওয়া যায়। মুখে সাধারণত হারপিস ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, যা হারপিস সিমপ্লেক্স(Herpes simplex virus) ও হারপিস জোস্টার(Herpes Zoster virus) নামে পরিচিত। হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস প্রধানত লালা এবং শরীরের অন্যান্য নিঃসৃত রসের মাধ্যমে মুখে সংক্রমিত হয়ে থাকে। এটি দুই ধরনের-টাইপ-১ ও টাইপ-২।
হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস দিয়ে প্রাথমিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে মাড়ি ও ঠোটে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে, যা জিনগিভো স্টোমাটাইটিস নামে পরিচিত। অনেক সময় শিশুদের ক্ষেত্রে মাড়িতে এ অবস্থার সৃষ্টি হলে, মনে হতে পারে তাদের দাঁত উঠছে। ডেন্টাল সার্জনদের মধ্যে যারা হ্যান্ডগ্লাভস ছাড়া রোগী দেখে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে হাতের আঙুলে হুইটলো হতে পারে, যা হারপেটিক হুইটলো (Herpetic whitlow)নামে পরিচিত। হুইটলো হলে আঙুলে ব্যথা হতে পারে। সেকেন্ডারি হারপিস বা কোল্ড সোর আঘাতের কারণে হতে পারে। সূর্যের আলোতে বারবার এবং বেশিক্ষণ থাকলে এবং মানসিক চাপযুক্ত অবস্থায় থাকলে।
হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের প্রাথমিক সংক্রমণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী আর কোন কষ্ট অনুভব করে না। রোগটি এভাবে আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়, যা হারপিস ল্যাবিয়ালিস নামে পরিচিত। বারবার হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ঠোটে ফুসকুড়ি হতে পারে এবং প্রদাহ দেখা দিতে পারে, যা চিলাইটিস (Cheilitis)নামে পরিচিত। সাধারণ মানুষের কাছে এ অবস্থাটি জ্বরঠোসা নামে পরিচিত। তবে সিফিলিসের কারণেও ঠোটে ঘা দেখা দিতে পারে। প্রজনন অঙ্গের বাইরে সবচেয়ে বেশি সিফিলিসের লক্ষণ দেখা যায় পুরুষদের ওপরের ঠোটে এবং মহিলাদের নিচের ঠোটে। এ সময় ঠোটে ক্ষত দেখা যেতে পারে।
ঠোটের প্রদাহকে আবার অ্যাংগুলার স্টোমাটাইটিসও বলা হয়। আয়রনের অভাবে শরীরে যে রক্তশূন্যতা হয় সে ক্ষেত্রেও অ্যাংগুলার স্টোমাটাইটিস হতে পারে।
ক্যানডিডা অ্যালবিকানস (ফাঙ্গাস রোগ) দ্বারা সংক্রমণের ক্ষেত্রেও ঠোটে প্রদাহ দেখা দিতে পারে। যাকে Thrash বা অরাল ক্যানিডিডিয়াসিস বলে। যারা প্রাপ্তবয়সে হারপেটিক সংক্রমণে আক্রান্ত হয় তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি আকারে হারপিস রোগ শরীরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সেখান থেকে এনকেফাইলাইটিসের মতো মস্তিষ্কেও প্রদাহ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হারপিস ভ্যারিলিসা জোস্টার ভাইরাসের প্রাথমিক সংক্রমণের কারণে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত ১০ বছরের কমবয়সী শিশুর জলবসন্ত হয়ে থাকে। হারপিস ভ্যারিসিলা জোস্টার ভাইরাস হাঁচির মাধ্যমে বাতাসে বিস্তার লাভ করে থাকে। মুখম-লের ট্রাইজেমিনাল নার্ভ হারপিস ভ্যারিসিলা জোস্টার ভাইরাস সংক্রমণে মুখে ব্যথা হতে পারে। এজন্য মুখের অভ্যন্তরে ঘা দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয়
রোগের লক্ষণগুলো ছাড়াও রক্তের ভাইরাস এন্টিবডি মার্কার পরীক্ষার মাধ্যমে হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস টাইপ-১ এবং টাইপ-২ সহজেই নির্ণয় করা যায়। রক্ত পরীক্ষাটি একজন অভিজ্ঞ ভাইরোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে করাতে হবে। পরীক্ষাটি কিছুটা হলেও ব্যয় সাপেক্ষ।
হারপিস রোগের চিকিৎসা
অ্যাসাইক্লোভির গোত্রভুক্ত ট্যাবলেট ভাইরাক্স (৭ থেকে ১৪ দিন) সংক্রমণের মাত্রা এবং ধরন অনুযায়ী খাওয়া যেতে পারে। তবে যারা দীর্ঘমেয়াদী হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে ওষুধ অনেক সময় উপকারে নাও আসতে পারে। কিন্তু রোগ যেন দ্রুত সংক্রমিত হতে না পারে সেজন্য আপনাকে ওষুধ সেবন করতেই হবে। রোগীকে এ সময় প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হয়। সর্বোপরি মুখের অভ্যন্তর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এজন্য ক্লোরোহেক্সিডিন মাউথওয়াশ ০.২% ব্যবহার করতে হবে দুই সপ্তাহের জন্য। গর্ভাবস্থায় ভাইরাক্স ট্যাবলেট সেবন করা যাবে না। তাছাড়া দুগ্ধদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যাদের কিডনি সমস্যা আছে অথবা রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি থাকে তাদের কোন অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা ঠিক নয়। তবে কিডনির সামান্য সমস্যা থাকলেও অ্যাসাইক্লোভির গোত্রভুক্ত ওষুধের পরিবর্তে অ্যালাসাইক্লোভির গোত্রভুক্ত ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে পারেন। ঠোটে ঘা বা ক্ষত থাকলে অ্যাসাইক্লোভির ক্রিম ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে সব রোগীর ক্ষেত্রে এমনটি আশা করা ঠিক নয়। মুখের অভ্যন্তরে বারবার ভাইরাস সংক্রমণ আলসাররূপে দেখা যায়। অতএব জ্বরঠোসা-ই হোক আর ঠোটে ঘা-ই হোক সব ধরনের রোগের সংক্রমণের চিকিৎসায় আপনাকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ
মোঃ ফারুক হোসেন
সূত্র