Topic: পরমাণু শক্তি বিশেষজ্ঞের চোখে জাপান সঙ্কট
জাপানে ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্প-সুনামি আঘাত হানার পর সেখানকার বেশ কয়েকটি পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটেছে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে বিস্ফোরণের পর তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর মাত্রা বেড়েছে। এ মাত্রা মানুষের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার মতো। এজন্য ওই কেন্দ্রের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় সব মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। সেখানকার সার্বিক অবস্থা জানতে সম্প্রতি লাইভ সায়েন্স এর পক্ষ থেকে আমেরিকার আর্গনই ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির প্রধান পরমাণু প্রকৌশলী টেমিপোট টাইও’এর এক সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এই সাক্ষাতকার থেকেই জেনে নেওয়া সম্ভব ফুকুশিমাতে আসলে কী ঘটছে।
প্রশ্ন: গলনের কারণে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা কীভাবে বিপর্যস্ত হয় ?
উত্তর: পারমাণবিক চুল্লির শক্তি আসে চেইন বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। চুল্লি একবার বন্ধ করে দেবার পর এই বিক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। জাপানের প্ল্যান্টগুলোও এই অবস্থায়ই ছিলো। কিন্তু এই বিক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে উৎপন্ন উপজাত উপাদানগুলোও অবিরাম ভাঙ্গতে থাকে। এতে তাপ তৈরি হয়। চুল্লির ভেতর ৬-৮ ভাগ তাপ এইভাবে আসে। এই তাপ কমাতে যদি শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা না যায় তাহলে এক সময় এই তাপ বাড়তেই থাকে। ফলে, তাপে জ্বালানি গলতে থাকে। আর এভাবেই এক সময় জ্বালানি চুল্লিতে ছিদ্র তৈরি হয়।
প্রশ্ন: পারমাণবিক গলনের সময় আসলে কী ঘটে?
উত্তর: পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে কঠিন ইউরেনিয়াম রড ব্যবহার করা হয়। শীতলীকরণের মাধ্যমে অতিরিক্ত তাপ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই রড গলে যায়। তখন শীতলীকরণের পানির সঙ্গে মিলে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস দহনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। ফলে চুল্লির অন্যান্য উপাদানও গলতে থাকে।
প্রশ্ন: পারমাণবিক গলন কী বন্ধ করা সম্ভব?
উত্তর: এই ধরনের গলন বন্ধ করতে জাপানের মত পানি গরম করার চুল্লিগুলোতে জরুরি শীতলীকরণ ব্যবস্থা চালু রাখা হয়। এর জন্য জেনারেটর ও ব্যটারির ব্যবস্থা থাকে। জাপানে ভূমিকম্পের পরপর সুনামি আঘাত হানায় সাগরের পানির তোড়ে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ব্যাটারির বিদ্যুৎ মজুদও শেষ হয়ে যায়। এই ভাবে চুল্লির শীতলীকরণ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। তাই শীতলীকরণ চালু করাই গলন বন্ধ করার একমাত্র উপায়। কোনভাবে আবার পর্যাপ্ত শীতলীকরণ চালু করা গেলে গলনের হার নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। জাপানের চুল্লি গুলোর কর্মীরা এ কারণেই শীতলীকরণ ব্যবস্থা চালুর জন্য সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: জাপানের এই ঘটনার সঙ্গে চেরেনবিল দুর্ঘটনার পার্থক্য কতটুকু ?
উত্তর: দু’দিক দিয়ে জাপানের এই ঘটনার সঙ্গে চেরেনোবিলের পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, জাপানের চুল্লিগুলো ছিলো বন্ধ এবং প্রথমবার ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় উপজাতের ক্ষয়ের কারণে ৬-৮ ভাগ চালু ছিলো। অন্যদিকে, দুর্ঘটনার কারণে চেরেনোবিলের চুল্লিটি বন্ধই করা যাচ্ছিলো না, সেই সঙ্গে এর শক্তি অনবরত বাড়ছিলো।
জাপানের চুল্লির গঠনও চেরেনোবিলের থেকে আলাদা। এ ধরনের গঠনের জন্য চেরেনোবিলের মত গ্যাস বের হয়ে বা চুল্লিতে ফাটল ধরে তেজস্ক্রিয় উপাদান সহজে বাইরে আসতে পারে না। একেবারেই ব্যবহার না হওয়ায় চেরেনোবিলের মত জাপানে গ্রাফাইটে আগুন ধরা সম্ভব নয়। চেরেনোবিলের ঘটনা ঘটেছিলো পারমাণবিক চুল্লির ভেতরে বিস্ফোরণের কারণেই। এর মধ্য দিয়ে সারা ইউরোপের আকাশে তেজস্ক্রিয় উপাদান ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জাপানের চুল্লিগুলোর কনটেইনমেন্ট গঠনের জন্য সেরকম কিছু ঘটা একেবারেই সম্ভব নয়। সেখানে পানির পাম্প বন্ধ হয়ে শীতলীকরণ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ায় পানির পাইপের মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রশ্ন: জাপানের পারমাণবিক ব্যবস্থার বড় ধরনের বিপর্যয়ের চেহারা কেমন হতে পারে ?
উত্তর: চুল্লির কনটেইনমেন্ট ব্যবস্থা কাজ না করলেই কেবল বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে। আর এভাবে পরিবেশে তেজস্ক্রিয় উপাদান ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ব্যবস্থা জ্বালানি শীতল করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলে এবং কনটেইনমেন্ট ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হলে বা ভেতরে এমন বাষ্পচাপ তৈরি হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব।