Topic: শবে বরাত-এর শরীয়ত ভিত্তিক প্রমাণ

চৌদ্দই শা'বান দিবাগত রাতটি হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত বা বরাতের রাত্র। কিন্তু অনেকে বলে থাকে কুরআন শরীফ-হাদীছ শরীফ-এর কোথাও শবে বরাত শব্দ নেই। শবে বরাত বিরোধীদের এরূপ জিহালতপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, নামায, রোযা, খোদা, ফেরেশতা, পীর ইত্যাদি শব্দ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর কোথাও নেই। এখন শবে বরাত বিরোধী লোকেরা কি নামায, রোযা ইত্যাদি শব্দ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ না থাকার কারণে ছেড়ে দিবে? মূলত শবে বরাত, নামায, রোযা, খোদা, ফেরেশতা, পীর ইত্যাদি ফার্সী শব্দ, আরবী শব্দ নয়। তাই ফার্সী শব্দ হিসেবে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ ব্যবহৃত হয়নি। বরং প্রচলিত শব্দগুলোর আরবী শব্দ লাইলাতুম মুবারাকাহ বা লাইলাতুন নিছফি মিন শা'বান, ছলাত, ছাওম, আল্লাহ, মালাইকা, মুর্শিদ বা শায়েখ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-


ফার্সী শব্দ                                                                              আরবী শব্দ
                                                   কুরআন শরীফ-এ ব্যবহৃত শব্দ                         হাদীছ শরীফ-এ ব্যবহৃত শব্দ
শবে বরাত                                           লাইলাতুম মুবারাকাহ                               লাইলাতুন নিছফি মিন শা'বান
নামায                                                 ছলাত                                                ছলাত                           
রোযা                                                  ছাওম                                                ছাওম                           
খোদা                                                  আল্লাহ                                               আল্লাহ                           
ফেরেশতা                                             মালাইকা                                            মালাইকা                       
পীর                                                    মুর্শিদ                                                শায়েখ                         

ফার্সী শব অর্থ রাত্রি এবং বরাত অর্থ ভাগ্য বা মুক্তি। সুতরাং শবে বরাত মানে হল ভাগ্য রজনী বা মুক্তির রাত।
মূলতঃ শবে বরাত এবং এর ফযীলত কুরআন শরীফ-এ আয়াত শরীফ এবং অসংখ্য হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন শরীফ-এ শবে বরাতকে লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদীছ শরীফ-এ শবে বরাতকে লাইলাতুন নিছফি মিন শা'বান বা শা'বান মাসের মধ্য রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ করেন,
وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ0  إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ 0 فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ 0 أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ 0

অর্থ: "শপথ প্রকাশ্য কিতাবের! নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমিই সতর্ককারী। আমারই নির্দেশক্রমে উক্ত রাত্রিতে প্রতিটি প্রজ্ঞাময় বিষয়গুলো ফায়ছালা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী।"  (সূরা দু'খানঃ ২-৫)

কেউ কেউ বলে থাকে যে, "সূরা দু'খানের উল্লেখিত আয়াত শরীফ দ্বারা শবে ক্বদর-কে বুঝানো হয়েছে। কেননা উক্ত আয়াত শরীফ-এসুস্পষ্টই উল্লেখ আছে যে, নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি........। আর কুরআন শরীফ যে ক্বদরের রাতে নাযিল করা হয়েছে তা সূরা ক্বদরেও উল্লেখ আছে।"এ প্রসঙ্গে মুফাসসীরকুল শিরোমণি রঈসুল মুফাসসিরীন বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেন,
"মহান আল্লাহ পাক তিনি “লাইলাতুম মুবারাকাহ” বলতে শা'বান মাসের মধ্য রাত বা শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন।  মহান আল্লাহ পাক তিনি এ রাতে প্রজ্ঞাময় বিষয়গুলোর ফায়ছালা করে থাকেন।" (ছফওয়াতুত তাফাসীর, তাফসীরে খাযীন ৪র্থ খন্ডঃ ১১২ পৃষ্ঠা, তাফসীরে ইবনে আব্বাস,তাফসীরে মাযহারী ৮ম খন্ডঃ ৩৬৮ পৃষ্ঠা, তাফসীরে মাযহারী ১০ম খন্ড, তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে খাযিন, তাফসীরে বাগবী, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে কবীর, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে আবী সাউদ, তাফসীরে বাইযাবী, দূররে মানছূর, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে কামলালাইন, তাবারী, লুবাব, নাযমুদ দুরার, মাদারিক)

লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে তার যথার্থ প্রমাণ সূরা দু'খানের ৪ নম্বর আয়াত শরীফ।
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ এই আয়াত শরীফেরيُفْرَقُ  শব্দের অর্থ ফায়ছালা করা।
প্রায় সমস্ত তাফসীরে সকল মুফাসসিরীনে কিরামগণ يُفْرَقُ (ইয়ুফরাকু) শব্দের তাফসীর করেছেন-
ইয়ুকতাবু অর্থাৎ লেখা হয়,
ইয়ুফাছছিলু অর্থাৎ ফায়ছালা করা হয়,
ইয়ুতাজাও ওয়াযূ অর্থাৎ বন্টন বা নির্ধারণ করা হয়,
ইয়ুবাররিমু অর্থাৎ বাজেট করা হয়,
ইয়ুকদ্বিয়ু অর্থাৎ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কাজেই ইয়ুফরাকু-র অর্থ ও তার ব্যাখার মাধ্যমে আরো স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, “লাইলাতুম মুবারাকাহ” দ্বারা শবে বরাত বা ভাগ্য রজনীকে বুঝানো হয়েছে। যেই রাত্রিতে সমস্ত মাখলুকাতের ভাগ্যগুলো সামনের এক বছরের জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়, আর সেই ভাগ্যলিপি অনুসারে রমাদ্বান মাসের লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরে তা চালু হয়। এজন্য শবে বরাতকে লাইলাতুত্ তাজবীজ অর্থাৎ ফায়ছালার রাত্র এবং শবে ক্বদরকে লাইলাতুল তানফীয অর্থাৎ নির্ধারিত ফায়ছালার কার্যকরী করার রাত্র বলা হয়। (তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে খাযীন, তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে বাগবী,  তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে লুবাব)

সুতরাং মহান আল্লাহ পাক যে সুরা দু'খান-এ বলেছেন, "আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি" এর ব্যাখ্যামুলক অর্থ হল "আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিলের ফায়ছালা করেছি"।
আর সুরা ক্বদর-এ "আমি ক্বদরের রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি" এর ব্যাখ্যামুলক অর্থ হল "আমি ক্বদরের রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি "।

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক শবে বরাতে কুরআন শরীফ নাযিলের সিদ্ধান্ত নেন এবং শবে ক্বদরে তা নাযিল করেন। হাদীছ শরীফেও শবে বরাতে সমর্থন পাওয়া যায়।

হাদীছে শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,
"হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহিাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত আছে। একদা মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! আপনি কি জানেন, লাইলাতুন নিছফি মিন শা'বান-এ কি সংঘটিত হয়? তিনি বললেন, হে মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এ রাত্রিতে কি কি সংঘটিত হয়? মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, এ রাতে আগামী এক বছরে কতজন সন্তান জম্মগ্রহণ করবে এবং কতজন লোক মৃত্যূবরণ করবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে বান্দার (এক বছরের) আমলসমূহ মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট পেশ করা হয় এবং এ রাতে বান্দার (এক বছরের) রিযিকের ফায়ছালা হয়"। (বাইহাক্বী, ইবনে মাজাহ্, মিশকাত শরীফ)

হাদীছ শরীফ-এ আরও ইরশাদ হয়েছে,
"হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, একদা মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনিার সাথে কোন এক রাত্রিতে রাত যাপন করছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোন উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের হুজরা শরীফ-এতাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর আমি তালাশ করে উনাকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফ-এফিরে এলে তিনিও ফিরে এলেন এবং বললেনঃ আপনি কি মনে করেন মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আপনার সাথে আমানতের খিয়ানত করেছেন? আমি বললামঃ ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের  হুজরা শরীফ-এতাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি শা'বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর তিনি বণী কালবের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন"। (বুখারী শরীফ, তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাযাহ, রযীন, মিশকাত শরীফ)

হাদীছ শরীফ-এ আরও ইরশাদ হয়েছে,
"হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ননা করেন, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি শা'বান মাসের ১৫ তারিখ রাত্রিতে ঘোষণা করেন যে, উনার সমস্ত মাখলুকাতকে ক্ষমা করে দিবেন। শুধু মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষকারী ব্যতীত।" (ইবনে মাযাহ্, আহমদ, মিশকাত শরীফ)

হাদীছ শরীফ-এ আরও ইরশাদ হয়েছে,
"হযরত আলী কাররামাল্লাহ ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম তিনি বর্ননা করেন, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যখন অর্ধ শা'বানের রাত উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগী করবে এবং দিনের বেলায় রোযা রাখবে। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি উক্ত রাতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করতে থাকেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি ক্ষমা করে দিব। কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করব। কোন মুছিবগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব। এভাবে সুবহে ছাদিক পর্যন্ত ঘোষাণা করতে থাকেন" (ইবনে মাযাহ্, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ)

হাদীছ শরীফ-এ আরও ইরশাদ হয়েছে,
"মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে এবং অর্ধ শা'বানের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে, সে ব্যক্তির অন্তর ঐদিন মরবে না বা পেরেশান হবে না যে দিন সকলের অন্তর পেরেশান থাকবে"। (মুকাশাফাতুল কুলুব)

শবে বরাতের রাতে দোয়া কবুল প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,
"মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, পাঁচটি রাত এমন রয়েছে যেগুলোতে দোয়া করলে তা রদ বা বাতিল হয়না । (১) পহেলা রজবের রাত (২) শা'বানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত (৩) জুমুয়ার রাত (৪) পবিত্র ঈদুল ফিতরের রাত (৫) পবিত্র ঈদুল আযহার রাত"। (দায়লামী শরীফ)

শবে বরাতের রাতে দোয়া কবুল প্রসঙ্গে অন্য হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,
"মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, নিশ্চয়ই দোয়া বা মুনাজাত পাঁচটি রাতে কবুল হয়ে থাকে। (১) পহেলা রজবের রাত (২) শা'বানের মধ্য রাত (৩) ক্বদরের রাত (৪) পবিত্র ঈদুল ফিতরের রাত (৫) পবিত্র ঈদুল আযহার রাত।” (মা ছাবাত বিস্ সুন্নাহ, গুনইয়াতুত্ ত্বালিবীন, মুকাশাফাতুল কুলুব)


সুতরাং শবে বরাত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের বর্ণনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত ।