Topic: মিলাদ উৎসব বা ঈদে মিলাদুন্নবী কি ইবাদত ?
বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য ইবাদত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা একান্তই প্রয়োজন। ইবাদত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ। অভিধানে শব্দটিকে প্রধানত পাঁচটি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যথা
১. বাধ্য হওয়া,অনুগত হওয়া,পরাধীনতা।
২. বিনয়ের সাথে আনুগত্য করা।
৩. পুজা করা।
৪. কোন কিছু নিজের জন্য অত্যাবশ্যক করে নেয়া। যেমন সে অত্যাবশ্যক করেছে,তাকে পৃথক হতে দেয়নি।
৫. বিরত রাখা,যেমন বলা হয় কোন জিনিষ তোমাকে আমা হতে বিরত রেখেছে।
পবিত্র কোরআনে এ পাঁচটি অর্থেই ইবাদত শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। সাধারনত ইবাদত যদি ইসলামী রীতিতে না হয় তবে তাকে আমাদের দেশে পূজা আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
ইবাদতের পারিভাষিক সংজ্ঞা :
নবী রাসুলগণের বর্ণনানুযায়ী আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করাকে ইবাদত বলে।
ইবাদত একটি ব্যাপক পরিভাষা,আল্লাহ পছন্দ করেন-সন্তুষ্ট হন এমন কথা ও কাজ সবই ইবাদতের অর্ন্তভুক্ত। তা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাই হউক না কেন।
আল্লাহর একাত্মবাদের ঘোষনা ও তাঁর দ্বীনের বিধি-বিধান প্রতিপালন করাকে ইবাদত বলে। বিণয় ও নম্রতা ইবাদতের মুল।
সার কথা হলো আল্লাহর নির্দেশিত রাসুল (সাঃ) প্রদর্শিত বিধান মতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা কিছুই করা হয় তা-ই ইবাদত । সুতরাং বুঝা গেল মুমিন বান্দা শরীয়াত মোতাবেক যা-ই করুন না কেন তাই ইবাদতের মধ্যে গণ্য।
“মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন”
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। ”। (সুরা আয-যারিআত-৫৬)
“ইবাদত/আ’মল বিশুদ্ধ হওয়া কবুল হওয়ার শর্ত”
ইবাদত কাকে বলে একথা জানার পর একথাটিও আমাদের জানা প্রয়োজন যে,এই ইবাদত আল্লাহর দরবারে কীভাবে কবুল হয়? ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার ভিত্তি/শর্ত বা কি ? কারন ইবাদত করার আসল উদ্দেশ্যই হলো কবুল হওয়া।
“ইবাদত কবুলের প্রথম শর্ত”
বান্দার যেকোন ধরনের ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য প্রথম ও অন্যতম শর্ত হচ্ছে “একনিষ্টতা”। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করা। এটি রুহ ও নফসের সাথে সম্পৃক্ত। ইবাদতের এটাই আসল কথা। যে ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ভিন্ন অন্য কোন মাকসুদ(উদ্দেশ্য) থাকে সে ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। কোরআনের অসংখ্য আয়াত ও বহু হাদিসে এর প্রমান পাওয়া যায় যেমন-
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاء وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ
আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ট হয়ে আন্তরিক ভাবে আল্লাহর দ্বীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে। আর তারা যেন সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দান করে। এটাই হচ্ছে সরল ও মজুবত দ্বীন (ব্যবস্থা) (সুরা আল-বাইয়্যেনা-আয়াত ০৫)
আমিরুল মোমেনিন হযরত উমর ফারুক (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি,সমস্ত কাজের ফলাফল নিয়ত অনুযায়ী হবে। প্রত্যেকেই যে নিয়তে কাজ করবে সে তাই পাবে। কাজেই যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য হয়েছে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য হয়েছে (বলে পরিগনিত হবে) । আর যে ব্যক্তি কোন পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের ইচ্ছায় কিংবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার আশায় হিজরাত করবে তার সেই হিজরাত সেই উদ্দেশ্যে হয়েছে বলে গণ্য হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন,আল্লাহ তোমাদের শরীর ও চেহারার দিকে ভ্রুক্ষেপ করেন না,বরং তোমাদের মনের ও কর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। (মুসলিম শরীফ)
“ইবাদত কবুলে ২য় শর্ত”:
ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার দ্বিতীয় অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো-আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপনি যে ইবাদত করছেন-তা অবশ্যই সুন্নাহ মোতাবেক হতে হবে। এটা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে ইবাদতটি করা হচ্ছে তা নিজ খেয়াল খুশিমত করা যাবে না। ইবাদতের জন্য আপনার হাত,পা, চোখ, কান, জবান, চেহারা, বিবেক-বুদ্ধি, অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি আপন খুশিমত পরিচালনা করলে চলবে না বরং তা সুন্নাহ মোতাবেক হতে হবে। ইবাদতটি আপনাপর দৃষ্টিতে যতই সুন্দর, যুক্তিযুক্ত, আকর্ষনীয়, সময়োপযোগী, কল্যাণময়ী হউক না কেন, আপনার নিয়ত যতই ভাল থাক না কেন,যতই আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেন না কেন সেই সেই ইবাদত যদি সুন্নাহ মোতাবেক না হয় তবে সেটি ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না। যে আ’মল আপনি করেছেন তার নমুনা নকশা গ্রহণ করতে হবে মহা নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের আ’মল হতে।ইবাদত কবুলের দ্বিতীয় অত্যাবশ্যকীয় শর্তের উপরে কোরআন-হাদীসের অসংখ্য দলিল বিদ্যমান।
এ ব্যাপারে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য নীচে তুলে ধরা হলো।
”এমন কথার কোনই মুল্য নাই যা আ’মল করা হয় না। কথা ও আ’মল কোনটাই গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষন না নিয়তের খুলছিয়াত থাকবে। কথা, আ’মল নিয়ত কেনটাই গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষন না এসব সুন্নাত মোতাবেক হবে।” (ইরশাদুত-তালেবিন)
তাফসিরে কাবিরে আল্লামা ফখরুদ্দিন রাযী (রঃ) বলেন,আল্লাহ তা’আলার বাণী,”উত্তম আ’মল এর ব্যাখ্যা মুফাসসীরীনে কেরাম কয়েক ভাবে করেছেন। একটি হলো এই যে, আ’মল এখলাসের সাথে নির্ভূল পন্থায় না হয়,তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অনুরুপভাবে যদি আ’মল এখলাস শুন্য হয় নির্ভূল হয় তবে তাও গ্রহণযোগ্য হবে না। এখলাসের সাথে হওয়ার অর্থ হলো-আ’মল একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া। নির্ভূল হওয়ার অর্থ হলো-আ’মল সুন্নাত মোতাবেক হওয়া।” (তাফসিরে কাবীর ৮ম খন্ড,২৪৩ পৃষ্ঠা আল আবুদিয়্যাহ২০-২১পৃঃ)
আহমদ ইবনে আবুল হাওয়ারী (রঃ) বলেন, “যে বব্যক্তি সুন্নত পরিপন্থী কোন কাজ করবে কার আ’মল বাতিল বলে গণ্য হবে।” (ই’তিছাম,১ম খন্ড ১১৪ পৃঃ)
হযরত আবু সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেন,”কোন কথা,আ’মল ও নিয়ত সুন্নাত মোতাবেক না হল্ তা গ্রহণযোগ্য হবে না।” (তালবীসু ইবলিস,পৃঃ ৯)
হযরত আঃ কাদির জিলানী (রঃ) বলেন, “আ’মলবিহীন কথা গ্রহণযোগ্য হবে না। ইখলাস ও সুন্নাতের অনুসরনবিহীন আ’মলও গ্রহণযোগ্য হবে না।” ( ফতহে রব্বানী,১ম খন্ড,পৃঃ ১৪) এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন-ফতুয়ায়ে রহিমিয়া,২য় খস্ড.২৮০-২৮২ পৃঃ)
সুতরাং মিলাদ উৎসব বা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন কারী ভাইদের মধ্যে নিয়তের খুলছিয়াত থাকলেও যেহেতু উৎসব পালন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, উৎসব পালন করা রাসুলে করীম, (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাতও নয় সেহেতু উক্ত মিলাদ বা ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসবটি কোনক্রমেই ইবাদতে গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়।